খুদে গোয়েন্দা পিকু ও আলী ইমাম
জহিরুল ইসলাম
|
![]() এই কাহিনির যিনি স্রষ্টা, তার নাম আলী ইমাম। শিশু-কিশোরদের জন্য তিনি লিখেছেন প্রায় পাঁচশ উপন্যাস। তার মধ্যে একটির নাম ‘অপারেশন কাঁকনপুর’। ওপরের অংশটুকু অপারেশন কাঁকনপুরের। এই উপন্যাসের পিকু চরিত্রটির স্রষ্টাও আলী ইমাম। সেই পিকুকে নিয়েই তার কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ ‘পিকু’। ‘অপারেশন কাঁকনপুর’, ‘রক্তমাখা পুঁথি’ আর ‘কুঠিবাড়ি রহস্য’- এই তিন উপন্যাস নিয়েই এই গোয়েন্দা সিরিজ। অপারেশন কাঁকনপুরের মূল চরিত্র পিকু। পিকুর মধ্যে গোয়েন্দা প্রবৃত্তি আছে ঠিকই তবে তার বেশি আগ্রহ প্রকৃতির রূপ পর্যবেক্ষণ। বাবা ফরেস্ট অফিসার হওয়ায় বদলির চাকরি। ছুটে বেড়ান এ এলাকা থেকে ও এলাকা। সঙ্গে থাকে পিকু। এবারে তিনি বদলি হয়েছেন কাঁকনপুরে। কাঁকনপুরের প্রকৃতির অপরূপ রূপ মুগ্ধ করে পিকুকে। বাবা অফিসে চলে গেলে সাঁওতালদের ছেলে মংলিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে। ঝরনা, বন, ঝোপঝাড় এসব ডিঙিয়ে পাহাড়ের দিকে হাঁটতে থাকে তারা। কাঁকনপুরে সাঁওতালদের একটা বস্তি আছে। নাম বাঘমুণ্ডী। ওখানেই থাকে মংলিরা। বছরে একবার করে উৎসব হয় সেখানে। গ্রামের সবচেয়ে পুরোনো গাছের কোটরে রাখা হয় সোনার হাঁসের মূর্তি। তাকে ঘিরে গোল হয়ে নাচে সাঁওতালরা। এই উৎসব দেখতে মংলিকে সঙ্গে নিয়ে ওদের গ্রামে যাচ্ছিল পিকু। পথে দেখা হয় ক্যানারি সাহেবের সঙ্গে। ক্যানারি নামের দ্বীপে অনেক দিন ছিল বলে এমন নাম তার। পিকু বাঘমুণ্ডী যাচ্ছে শুনে চমকে ওঠেন ক্যানারি সাহেব। বাঘমুণ্ডী যেতে নিষেধ করেন পিকুকে। ভয় দেখানোর চেষ্টাও করেন। ক্যানারি সাহেবের এমন আচরণের কারণ খুঁজে পায় না পিকু। বিকালের দিকে সাঁওতালি গাঁয়ে পৌঁছে যায় ওরা। একটা সময় গোধূলিকে বিদায় দিয়ে মস্তবড় গোল চাঁদ ওঠে আকাশে। সর্দার এসে গাছের কোটরে রাখেন সোনার হাঁস। ঠিক তখনই আচমকা এক ঘটনা ঘটে। পরপর দুবার গুলির শব্দ শোনা যায়। আতঙ্কে যে যার মতো ছুটে পালাতে থাকে। সুযোগ বুঝে কালো কাপড় জড়ানো দুটো লোক সোনার হাঁসটা তুলে নিয়ে দৌড়াতে থাকে। কিন্তু বেড়াল আক্রমণ করে বসে একজনকে। শেষমেশ তারা পালাতে পারলেও বিড়ালের আঁচড়ের ক্ষত বয়ে নিয়ে যায় সঙ্গে করে। উৎসবের দিনে এমন ঘটনা ঘটে যাওয়ায় বাঘমুণ্ডীর সবার মন খারাপ হয়। পিকু নিজেও চাপা কষ্ট অনুভব করে। কিন্তু সে যে স্বভাব গোয়েন্দা। তাই রহস্যের একটা ক্লু পেয়ে যায় পিকু। সেই ক্লু ধরেই সে নেমে পড়ে রহস্য উদঘাটনে। ‘কুঠিবাড়ি রহস্য’ উপন্যাসে নিরন্তর পাখি সন্ধান আর পাখি পরিক্রমা নিয়ে মেতে থাকে পিকু আর তার বন্ধুরা। দেশের নানা জায়গায় পাখিদের খবরাখবর নিয়ে ওদের ঔৎসুক্যের যেন শেষ নেই। একটি ক্লাবও আছে ওদের, নাম ব্লু পিজিয়ন। নাগাল্যান্ডের তাহিমায় বার্ষিক ধনেশপাাখির উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য ওদের কাছে আমন্ত্রণ আসে। পিকু এই উৎসবে যোগ দেয়। পাখির উৎসবে যোগ দিতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ে এক প্রাচীন গুপ্তবিশ্বাসের রহস্যের সঙ্গে। একের পর এক শিশু খুন হচ্ছে। আসাম থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সুন্দরবনে ছড়িয়ে আছে সেই রহস্যের জাল। কাহিনির গতিময়তায় সেই রহস্যের জাল ভেদ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লেখকের বর্ণনায় উঠে আসে সুন্দরবন ও আসামের পাহাড়ি অঞ্চলের নাম না জানা একগাদা পাখির মজার মজার তথ্য। ‘রক্তমাখা পুঁথি’ উপন্যাসে গভীর রাতে চৌধুরী লজের ছাদে দেখা মেলে এক ছায়ামূর্তির। রহস্যময় অভিশপ্ত এক পুঁথির সন্ধানে তার আগমন। পুঁথিতে লেখা আছে হার্মাদ দস্যুর গুপ্তধনের সন্ধান। অনেক মানুষ এই পুঁথি দখলে নিতে চেয়েছে, কত লোকের রক্ত লেগে আছে এতে। প্রেততত্ত্বের চর্চা করত এমন কিছু ভয়ংকর লোক জড়িত এই প্রতিযোগিতায়। দুঃসাহসী কিশোর পিকু নেমে পড়ল পুঁথি রহস্য সমাধানে। মৃত্যুদূতের ছোবল এড়িয়ে কষাড় জঙ্গলে শ্মশানের রাউ চণ্ডালের ভিটার দিকে এগিয়ে চলে সে জলদস্যুর পুঁথি উদ্ধার করতে। আলী ইমামের লেখা এমন এক মুগ্ধতা ছড়ায় যে পড়তে শুরু করলে শেষ না করে উপায় নেই। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের তো নয়ই। কারণ শিশু-কিশোরদের ভাবনা ও কল্পনার জগৎ পুরোপুরি রপ্ত করতে পেরেছিলেন তিনি। ছোটদের কল্পনাকে তিনি ছোটদের মতো সহজ-সরল ভাষায় ফুটিয়ে তুলতেন বইয়ের পাতায় পাতায়। সেসব রহস্য আর রোমাঞ্চ কাহিনি পড়তে পড়তে তার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে বেশিরভাগ পাঠক। একপর্যায়ে পাঠকের মনে হবে, সে নিজেই বুঝি গল্পের মূল চরিত্র। আলী ইমাম বিশ্বাস করতেন, বই মানুষকে স্বপ্ন দেখতে শেখায়। তাই সবসময়ই তিনি চেষ্টা করেছেন এমন সব বই রচনা করতে যে বই শিশুদের স্বপ্ন দেখাবে, ভাবতে শেখাবে, কল্পনার জগতে পাখা মেলতে শেখাবে। সেই প্রয়োজন মেটানোর দায় থেকে তিনি রচনা করেছেন প্রায় ৭০০ বই। তার উল্লেখযোগ্য শিশু-কিশোরসাহিত্যের মধ্যে রয়েছে- দ্বীপের নাম মধুবুনিয়া, তিরিমুখীর চৈতা, রুপোলী ফিতে, শাদা পরী, পাখিদের নিয়ে, প্রবাল দ্বীপের আতঙ্ক, জাফলঙ্গের বিভীষিকা, সবুজ বাড়ির কালো তিতির, পিশাচের ছায়া, হিমছড়ির ভয়ঙ্কর, চিলামুখীর বিলে, রক্তপিশাচ তিতিরোয়া, ভয়ঙ্করের হাতছানি, ইয়েতির চিৎকার, গাঙচিল দ্বীপের বিভীষিকা ইত্যাদি। এ ছাড়া তার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ ও গবেষণাগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- সেসুলয়েডের পাঁচালী, কাছের পাহাড় দূরের পর্বত, বিদেশি পর্যটকদের চোখে বাংলাদেশ, প্রাচীন বাংলা বৌদ্ধ বিহার, বাঙলা নামে দেশ, দেখোরে নয়ন মেলে, কাছে থেকে দূরে ইত্যাদি। গত ২১ নভেম্বর মারা গেছেন বাংলা শিশুসাহিত্যের দিকপাল এই লেখক। তোমরা বড় হতে হবে তার সম্পর্কে আরও জানবে এবং তার লেখাগুলো পড়ে নিজেদের কল্পনার জগৎকে সমৃদ্ধ করবে নিশ্চয়। |