বাংলা সাহিত্য সমালোচনার সূচনাকাল
আলম তৌহিদ
|
![]() বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মধ্যযুগকে সমৃদ্ধ করেছে লোক ও বৈষ্ণবসাহিত্য। কিন্তু সেগুলোর প্রকৃত সমালোচনা রচিত হয়েছে খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। বাংলা কবিতা-উপন্যাস-ছোটগল্প তখনও জন্মলাভ করেনি। তাই ১৫০ বছর আগে প্রকৃত বাংলা সমালোচনার কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। বাংলা সমালোচনার বীজে যখন অংকুরোদ্গম হলো, তখন সংস্কৃত নন্দনশাস্ত্রের রসে পুষ্টিলাভ করে শুরু হলো তার পথচলা। সংস্কৃতে কাব্য-সাহিত্যের বিষয় এবং অঙ্গকে বিচার করা হয়েছে আলাদাভাবে এবং কতগুলো বাঁধাধরা নিয়মের শৃঙ্খলে। প্রাচীন সংহিতাকারদের মতে, কাব্যের রসাস্বাদন করার অধিকার সবার নেই। তারা মনে করত ব্রহ্মাবর্ত্ত ও আর্যাবর্ত্ত-বহির্ভূত সারা ভারতবর্ষ মেøচ্ছদেশ। রসের সংস্কৃত সূত্র পালন করে যে কাব্য রসোত্তীর্ণ হতে অপারগ হলো, তাকে ম্লেচ্ছকাব্য বলে বাতিল করে দিলেন। যখন বৌদ্ধগান ও দোঁহা, বৈষ্ণব পদাবলি, শূন্যপুরাণ, মনসামঙ্গল, চণ্ডীর গান পাঠক ও সমালোচকের অন্তরে অধ্যাত্মভাব ও ভক্তিরস জাগিয়ে তুলল, তখনই সংস্কৃত রসজ্ঞেরা বাংলা সাহিত্যের বিচার সভায় রাজাসন দখল করলেন। তারপর থেকে বিক্ষিপ্তভাবে সমালোচনার আবির্ভাব হতে লাগল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজি শিক্ষার ক্ষীণ আলোর দেখা যখন বাঙালিরা পেল, তখন থেকেই সাহিত্য সৃষ্টিও নতুন গতি পেল। কিছু কিছু সমালোচনা সাহিত্যেরও জন্ম হতে লাগল। সাহিত্য ক্ষেত্রে স্বীয় প্রতিভায় আবির্ভূত হলেন ঈশ্বরগুপ্ত, কালীপ্রসন্ন সিংহ, টেকচাঁদ ঠাকুর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রমুখ। আর সমালোচকরা পেয়ে গেলেন ‘আলালের ঘরের দুলাল’, ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সা’, ‘তিলোত্তমা কাব্য’, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ প্রভৃতি উপন্যাসে ও কাব্যে সমালোচনার রসদ। কলকাতায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পর ক্যাপ্টেন রিচার্ডসন ও অন্য ইংরেজ পণ্ডিতদের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করে যেসব বাঙালি ছাত্র ইউরোপীয় সাহিত্য ও সমালোচনার গতি-প্রকৃতির সংস্পর্শে এসে তাকে বাংলা ভাষা-সাহিত্যে প্রয়োগ করছিলেন, ঈশ্বরগুপ্তের ‘প্রভাকর’ প্রত্রিকায় তাদের বিরোধিতা করে বিভিন্ন লেখা ছাপা হচ্ছিল। ১৮৪৪ সালে ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ পত্রিকা প্রকাশ হয়। এই পত্রিকায় ইংরেজি ভাষায় বাংলা সাহিত্যের সমালোচনা ইংরেজ ও বাঙালি সমালোচকরা লিখতে শুরু করেন। ‘রহস্য সন্দর্ভ’ ও ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকাতেও বাংলা সমালোচনা প্রকাশ হতো। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫), ‘কপালকুণ্ডলা’ (১৮৬৬) ও ‘মৃণালিণী” (১৮৬৯) প্রকাশের পর ১৮৭১ সালে তিনি নিজেই ছদ্মনামে ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ পত্রিকায় একটি ধারাবাহিক সমালোচনা লিখলেন ইংরেজিতে। ১৮৭২ সালে ‘বঙ্গদর্শন’ প্রকাশ হলে এই পত্রিকায় বাংলা সমালোচনা সাহিত্য কিছুটা নতুন মাত্রা পায়। পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথ ‘ভারতী’ ও ‘সাধনা’ পত্রিকায় সমালোচনাকে জীবন্ত ও সুন্দর করে তুললেন। বঙ্কিমই বাংলা সমালোচনায় প্রাণপ্রতিষ্ঠাকারী, আর রবীন্দ্রনাথ দান করলেন মাধুরী। রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করেই একটি সমালোচক চক্র গড়ে উঠেছিল। তারা ‘সবুজ পত্র’ পত্রিকার মাধ্যমে নিজেদের মতবাদ প্রচার করতে লাগলেন। প্রমথ চৌধুরী, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, অজিত কুমার চক্রবর্তী এবং আরও অনেকেই এই চক্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মোহিতলাল মজুমদার বাংলা সমালোচনার ক্ষেত্রের পরিসর আরও বিস্তৃত করেন। তবে তিনি সংকীর্ণভাবে সাহিত্যের সৌন্দর্য ও রসের ব্যাখ্যা করেছেন, রবীন্দ্রনাথের কাজকে অতিক্রমণের জন্য তা যথেষ্ট নয়। সুকুমার সেন, সুবোধ সেনগুপ্ত, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রিয়রঞ্জন সেন প্রমুখ অধ্যাপকরা বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের কলেবর বৃদ্ধি করেছেন। তবে তাদের কাজ ছিল খুব বেশি পণ্ডিতিময় ও একাডেমিক। দীনেশচন্দ্র সেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনেক মূল্যবান রচনা উদ্ধার করেছেন, এগুলোর সামাজিক ইতিহাসও কিছু কিছু বর্ণনা করেছেন। কিন্তু ঐতিহাসিক ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে সুবিন্যস্তভাবে সাহিত্যের বিশ্লেষণ করেননি। তবে সমালোচনা সাহিত্যে সজনীকান্ত দাস যথেষ্ট কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এ কথা নিঃসংশয়ে বলা যায়, রবীন্দ্র-পরবর্তী সময়েও সমালোচনা সাহিত্য খুব বেশি অগ্রসর হয়নি। বাংলা সাহিত্য সমালোচনার গোড়ার দিকের কিছু দৃষ্টান্ত থেকে সহজেই বোধগম্য হবে তা কীভাবে ধীরে ধীরে আজকের পর্যায়ে এসেছে। সে সময় ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত বাংলা সমালোচনার ধরন ছিল এ রকম- ‘নূতন পুস্তক। সম্প্রতি দুই-তিন বৎসর হইল মোং কলিকাতার হিন্দুদের শাস্ত্রসিদ্ধ সহমরণের বিষয়ে কেহ প্রতিবাদী হইয়াছেন তন্নিমিত্ত কলিকাতার শ্রীযুক্ত বাবু কালাচান্দ বসুজা এক নূতন পুস্তক রচনা করিয়া ছাপাইয়াছেন। সে পুস্তকে সহমরণ নিষেধকর কথা ও স্বমতাসিদ্ধ মুনি প্রণীত বচনও আছে এবং বাঙ্গালা ভাষাতে তাহার তর্জ্জমা আছে এবং সেই বিষয়ের ইংরেজি ভাষাতে পৃথক এক কেতাব অতি সুন্দররূপে তর্জ্জমা। এই পুস্তক অত্যল্পদিন প্রকাশ হইয়াছে।’ (সমাচার দর্পণ-১৮ সেপ্টেম্বর ১৮১৯) এই পত্রিকায় অপর একটি সমালোচনার নমুনা- ‘নূতন পুস্তক। শ্রীযুক্ত বাবু নীলরতন হালদার মহাশয় বহু-দর্শন নামে এক নূতন পুস্তক করিয়া শ্রীরামপুরের ছাপাখানাতে ছাপাইতে আরম্ভ করিয়াছেন সে পুস্তক দ্বারা মূর্খ লোকও সভাসৎ হইতে পারিবেক। যেহেতুক ইংরেজি ও বাঙ্গালা ও সংস্কৃত এবং পারসি ও লাটিন প্রভৃতি নানা দৃষ্টান্তে একস্থানে সংগ্রহ করিয়াছেন।’ (সমাচার দর্পণ-২০ আগস্ট ১৮২৫) এই সমালোচনাগুলো পাঠ করলে বোঝা যায় তখন সমালোচনা সাহিত্যের যাত্রা শুরু হয়েছে, কিন্তু কথা ফোটেনি। ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ পত্রিকা প্রকাশ হওয়ার পর ইংরেজ পণ্ডিতদের প্রভাবে বাংলা সমালোচনা একটা নতুন পথের দিশা পেয়ে যায়। এ সময় সাহিত্য ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের আবির্ভাব সমালোচনা সাহিত্যকেও নবজীবন দান করে। ১৮৬৫ সালে ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসের সমালোচনা ছাপা হয়েছিল। সেই সমালোচনার অংশবিশেষ নিম্নরূপ : “বাঙ্গাল ভাষায় নূতন উপখ্যান এ পর্যন্ত দৃষ্ট হয় নাই; দুর্গেশনন্দিনী-গ্রন্থকার যদিও স্বপ্রণীত পুস্তক মধ্যে স্থানে স্থানে ইংরেজিভাব সন্নিবেশিত করিয়াছেন, তথাপি যখন ইহা অনুবাদিত পুস্তক নহে, তখন ইহা অবশ্যই নূতন। যখন একটি ভাষার সৃষ্টি হইয়াছে তখনই তাহার সঙ্গে সঙ্গে সেই ভাষার গর্ভজাত সন্তানোৎপত্তির আবশ্যকতা রহিয়াছে; সে সন্তান কোথায়? পাঠকগণ স্মরণ করিয়া বলুন তাঁহারা বাঙ্গালা ভাষায় লিখিত কখানি মূলগ্রন্থ পাঠ করিয়াছেন? বাস্তবিক বঙ্কিমবাবু এই পুস্তকে অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করিয়া বাঙ্গালার প্রথম উপাখ্যানকার উপাধির অধিকারী হইয়াছেন।”(সংবাদ প্রভাকর-১৪ এপ্রিল ১৮৬৫) ‘রহস্য-সন্দর্ভ’ পত্রিকায়ও ‘দুর্গেশনন্দিনী’র একটি সমালোচনা ছাপা হয়। সমালোচক লেখেন-‘ এসব সমালোচনা পাঠ করে বোঝা যায় বাংলা সমালোচনা তখনও ভালোলাগা-মন্দলাগার অনুভূতি প্রকাশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তখনও সমালোচনা নিজস্ব পথের সন্ধান পায়নি।
|