ওয়ার্ল্ড অব এইট বিলিয়ন : উৎসব না আশঙ্কা
লায়লা ফেরদৌস হিমেল
|
![]() প্রজননের মাধ্যমে প্রজন্ম তৈরির প্রক্রিয়াটি মানবের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রজননের মাধ্যমে মানুষ তার প্রতিরূপ বংশধর সৃষ্টি করে। বিশ্বের সব প্রাণী এমনকি উদ্ভিদও একই প্রক্রিয়ায় বিশ্বের বুকে নিজ নিজ প্রজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখছে। বর্তমান জনসংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের আবাস, খাদ্য, বস্ত্র, নিরাপত্তা, চিকিৎসা সুবিধা না বাড়ালে জনসংখ্যার এ বৃদ্ধি কেবল সংকটই বাড়ায়। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের প্রধান নাতালিয়া কানেম এ মত স্বীকার করে বলেছেন, ‘নিছক মানুষের সংখ্যা ভয়ের কারণ নয়’। তবে এ বাস্তবতায় জন্মে নতুন কিছু প্রশ্ন। বাড়তি মানুষ মানেই বাড়তি অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষাসহ বাড়তি সব প্রয়োজন। এই বাড়তি প্রয়োজনের চাহিদা পৃথিবী পূরণ করতে সক্ষম কি না তা ভাবাচ্ছে বিশ্ববাসীকে। ‘ওয়ার্ল্ড পপুলেশন প্রসপেক্টাস-২০২২’ শীর্ষক জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন বলছে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের প্রজনন হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ২০৪৫ সাল নাগাদ এ দেশের ভূখণ্ডে জনসংখ্যার এ ঘনত্ব আরও বাড়বে বলেই বিশেষজ্ঞের ধারণা। তখন বাংলাদেশে প্রতি কিলোমিটারে বাস করবে ১,৫৪২ জন। তবে শতাব্দীর শেষ নাগাদ চেষ্টা করলেই এ হার কমিয়ে আনা সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা। বাংলাদেশে গার্মেন্টস সেক্টরে কর্মরত শ্রমিকদের অধিকাংশই গ্রামের যৌথ পরিবার ভেঙে শহরে এসে একক পরিবার গঠন করে। কর্মজীবনের পাশাপাশি একাধিক সন্তানের দেখাশোনা করা কষ্টসাধ্য বলে তারা একাধিক সন্তান জন্মদান থেকে বিরত থাকছে। তবে এ ক্ষেত্রে সহজ ও সাবলীল জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সহজলভ্য ও সামর্থ্যরে মধ্যে থাকায় তা গ্রহণ ও প্রয়োগের ব্যপারে আগ্রহী হয়ে উঠছে জনসাধারণ। তবে স্থায়ী বা দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতির দিকে দম্পতিদের অনাগ্রহের কথা জানা যায় পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক বিবৃতি থেকে। সেখানে বলা হয়, ঢাকাসহ দেশের সব বিভাগেই জন্মনিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতিতে আগ্রহ হারাচ্ছে দম্পতিরা। কেবল ঢাকাতেই এর হার ৩২.৫৯। জাতিসংঘ বলছে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রধানতম কারণ। কেননা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় মৃত্যুহার কমেছে এবং বেড়েছে মানুষের গড় আয়ু। এর সঙ্গে যুক্ত হয় লিঙ্গবৈষম্য। বিপরীত লিঙ্গের শিশু জন্ম দেওয়ার আশা থেকে একই লিঙ্গের একাধিক শিশু জন্ম দেওয়ার ঘটনা বিরল নয়। উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থার আওতায় নারীর শরীরে মানানসই মাত্রার দীর্ঘমেয়াদি জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী প্রস্তুত হলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির এ হার দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। নারীর পাশাপাশি পুরুষের শরীরে প্রয়োগ করা যায় এমন দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতির আবিষ্কারও এ যাত্রায় সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা যেমন মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে, তেমনি মাতৃ মৃত্যুহার কমিয়েছে, তেমনি জনসংখ্যা বৃদ্ধিতেও প্রভাব ফেলেছে পরোক্ষভাবে। অথচ আমাদের লোককথা, উপকথা, পুরাণ ও ইতিহাসে দত্তক সন্তানের সাফল্যময় জীবনের নজির কম নয়। রামের দিদি শান্তা তার পালক পিতার রাজ্যের খরামুক্তিতে সহায়তা করেছিলেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর স্বয়ং ছিলেন একজন দত্তক পুত্র। অ্যাপল কর্তা স্টিভ জোবস, নেলসন ম্যান্ডেলা বড় হয়েছিলেন পালক পিতামাতার তত্ত্বাবধায়নে। তাই পালিত সন্তান নিয়ে সমাজের নেতিবাচক মনোভাবের ইতি টানা যেতেই পারে। দত্তক নেওয়ার মাধ্যমে শিশুকে উন্তত মানের প্রতিপালনের নিশ্চয়তা প্রদানের পাশাপাশি বিশ্বের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক ভূমিকা রাখা সম্ভব। সেই সঙ্গে প্রয়োজন প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে সঠিক ধারণা প্রদান যা শুরু হওয়া উচিত নির্দিষ্ট একটি বয়সের পর থেকেই। প্রজনন অঙ্গ ও প্রজনন পরিকল্পনা সম্পর্কে সঠিক ধারণা কেবল জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণেই সঠিক ভূমিকা রাখবে না, প্রজনন অঙ্গ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে সমাজে বিদ্যমান নানা ব্যভিচার, যেমন-ধর্ষণ, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, অল্প বয়সে সন্তান ধারণ প্রভৃতি লোপ পাবে। সমাজে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ বা অল্পবয়সে সন্তান ধারণ প্রভৃতি প্রচলিত প্রথা লোপ পেলে শিশু জন্মের হার নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জনসংখ্যার অধিক বৃদ্ধির পেছনে ধর্মীয় অনুভূতি ও অপব্যাখ্যা বিশেষ প্রতিক্রিয়াশীল বলে মনে হয়। যদিও পরিবার পরিকল্পনা নৈতিক সিদ্ধান্ত, যা সবার মঙ্গল বয়ে আনতে পারে এবং নিঃসন্দেহে এটি মানুষের মৌলিক অধিকার। লেখক: শিক্ষক, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় |