প্রকাশ: মঙ্গলবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২২, ১১:৪৩ এএম (ভিজিট : ১২৫)
অঘ্রানে ভরা ক্ষেতের মধুর হাসি, হেমন্তের রিক্ত বেলা, ভাদ্রের গুমোটের পর শীতলতার পরশ, নবান্নের আবাহন- ঠিক কোন কারণে যে ডিসেম্বর এলেই বলতে ইচ্ছে করে ‘তোমার মতো এমন টানে কেউ তো টানে না,’ সেটি ভাবতে গেলে আমাদের মতো একটি প্রজন্মের মানুষের মনে সবার আগে মনে পড়ে যায় একাত্তর সালের কথা। ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই বাংলার মুক্তিকামী মানুষ বুঝতে পারছিল বিজয় অত্যাসন্ন। মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত হামলায় দিশেহারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে কোণঠাসা করে মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ীর বেশে এগিয়ে আসছিলেন ঢাকা অভিমুখে। এ সময় মিত্র বাহিনীর বিমান হামলার সময় ঢাকার মানুষ সব বিপদ উপেক্ষা করে উল্লাসে মেতে উঠত যার যার বাড়ির ছাদে। নিচু হয়ে উড়ে যাওয়া ভারতীয় বিমান থেকে অজস্র কাটা ঘুড়ির মতো বাতাসে ভেসে নেমে আসত পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতি আত্মসমর্পণের আহ্বান ছাপা লিফলেট। ডিসেম্বরের এক শীতের রাতে ঢাকার আকাশে উড়ে আসা যুদ্ধবিমানের আলোকমালায় আমরা দেখতে পেতাম বিজয়ের ভোরের বর্ণচ্ছটা।
এতদিন পথে বের হলেই দেখা যেত লোকজনের মধ্যে ত্রস্ত পলায়নপর ভঙ্গি, কোনো রকমে বাইরের কাজ সেরে ঘরে ফিরতে পারলেই যেন নিরাপত্তার দেয়ালের পেছনে গা-ঢাকা দেওয়া যাবে। ডিসেম্বর ঘনিয়ে এলে বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চোখে পড়তে থাকে সতর্ক সন্ত্রস্ত চোখে ভিনদেশি সেনাদল এদিক-সেদিক তাকিয়ে নির্জন জনপদের পাশ ঘেঁষে চলে যেতে থাকে সেনানিবাসের দিকে। ট্রাকের জান্তব শব্দের নিচে চেপে রাখতে চায় ওদের ভয়। সেই আসন্ন শীতের দিনগুলোতে জবুথবু মনে হতো রণক্লান্ত ও সন্ত্রস্ত হানাদার বাহিনীর জলপাই রঙের কনভয় ও জিপগুলোকে। একদা হিংস্র মুখগুলোকে আতঙ্কে ফ্যাকাশে মনে হতো। ডিসেম্বর মাস এলে মনে পড়ে ঢাকার মানুষ আসন্ন চূড়ান্ত লড়াইয়ের তীব্রতার উদ্বেগ ও সংশয় ভুলে গিয়ে প্রতীক্ষায় প্রহর গোনা শুরু করে কখন রাস্তায় নেমে চিৎকার করে তুলতে পারবে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি। সারা বাংলার মানুষের কাছে তখন পাকা ফসলের গানের চেয়ে সুমিষ্ট মনে হতো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্তলাল...’ আর ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি’ দেওয়ার সুর। ডিসেম্বরের প্রথম দিনগুলোতে কিছু মেধাসম্পন্ন বাঙালির ঘরে উঠেছিল সংগোপন কান্নার রোল, যার হাহাকার শীতের কুয়াশায় ভেসে গিয়ে পৌঁছেছিল রায়ের বাজারের জলাভূমির তীরে।
ডিসেম্বর হেমন্তের আর নবান্নের মাস, পাকা ফসল আর নমিত আবহাওয়ার মাস, সোনালি ধান আর সুফলা সবজির মাস, বাংলার রূপমুগ্ধ ভ্রমণ আর উৎসবের মাস, ভূমিহীন মানুষের ফসল কুড়ানোর মাস- তবুও সব ছাড়িয়ে ডিসেম্বর আসে আমাদের যুদ্ধজয়ের স্মৃতি নিয়ে। ডিসেম্বর আমাদের কৃষকের পূর্ণতার কাল, বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের বিজয় সেই পূর্ণতাকে ভরিয়ে দেয় কানায় কানায়। ডিসেম্বর এলেই আমাদের মনে পড়ে ‘পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত/ ঘোষণার ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলে, /নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগি^দিক এই বাংলায়/ তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা।’