চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে সামনে রেখে স্বতন্ত্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পিরোজপুরকে (বশেমুরবিপ্রবিপি) গড়ে তুলতে চাই। আর্টস এবং সোশ্যাল সায়েন্সের বিষয়গুলো খুলতে চাচ্ছি না। ডিজিটালাইজড গ্রিন ক্যাম্পাস হবে। পিরোজপুর কোস্টাল এরিয়া, তাই এটিকে বিবেচনায় নিয়ে কোস্টাল ইকোনমি, ওয়াটার রিসোর্স, মডার্ন ফিশারিজ, ক্লাইমেট চেঞ্জ বিষয়গুলো প্রাধান্য দেওয়া হবে। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে নতুন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা ভর্তির সুযোগ পাবে।
বৃহস্পতিবার সময়ের আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পিরোজপুরের (বশেমুরবিপ্রবিপি) প্রথম উপাচার্য অধ্যাপক ড. কাজী সাইফুদ্দীন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী সাইফুদ্দীনকে গত ১৮ সেপ্টেম্বর পিরোজপুরের এ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপচার্য হিসেবে নিয়োগ দেন আচার্য ও রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে পরিকল্পনা ও স্বপ্ন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন তিনি। অধ্যাপক সাইফুদ্দীন বলেন, ‘যুক্তরাজ্যে ল্যাংকাস্টার ইউনিভার্সিটিতে রিসার্স ফেলো হিসেবে কাজ করতাম। ছুটিতে দেশে এসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করি। তখন আমার অনেক বন্ধু এটাকে ভুল সিদ্ধান্ত বলেছিলেন। ব্রিটিশ পাসপোর্ট ফেলে কেউ বাংলাদেশে থাকে না-এমন মন্তব্য ছিল তাদের। সেসব বন্ধু এখন বলছেন, তুমি সার্থক, তুমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পিরোজপুরের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য হয়েছ।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়টি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে যে ধরনের শিক্ষা জরুরি সেটাকে প্রাধান্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর বিষয়গুলো সাজাতে চাই। যেমন মেডিকেল টেকনোলজি বিষয় চালু করতে চাই। এক্স-রে, ইসিজিসহ বিভিন্ন মেডিকেল যন্ত্রপাতি তৈরিসহ নানা বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। আমি আইসিডিডিআরবি (আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ) বায়োকেমিস্ট্রি, মাইক্রোবায়োলজি বিষয়ে বিশ্বে শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান, এ গবেষণা কেন্দ্রকে সংযুক্ত করতে চাই।’
অধ্যাপক কাজী সাইফুদ্দীন বলেন, ‘পিরোজপুর কোস্টাল এরিয়া, তাই এটিকে বিবেচনায় নিয়ে কোস্টাল ইকোনমি, ওয়াটার রিসোর্স, মডার্ন ফিশারিজ, ক্লাইমেট চেঞ্জ বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিতে চাই। অন্যান্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো হবে না এ বিশ্ববিদ্যালয়। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় করতে চাই। এ জন্য আর্টস অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্স বিষয়গুলো খুলতে চাচ্ছি না।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিজিটালাইজড গ্রিন ক্যাম্পাস হবে। বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত আমাদের গ্রিন গার্মেন্টস আছে। ডিজিটালাইজড ক্যাম্পাস হবে। বহিরাগত অনুপ্রবেশ কিংবা কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে সে জন্য সিসি ক্যামেরায় পুরো ক্যাম্পাস নজরদারিতে থাকবে।’
বশেমুরবিপ্রবিপি উপাচার্য বলেন, ‘আমি চাই, আগে ছাত্র ভর্তি হোক। ছাত্র না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় হয় না। কর্মকর্তা আর কর্মচারী, ইট, বালু, সিমেন্ট দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় হয় না। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে। শুরুতে ফ্যাকাল্টি অব ইঞ্জিনিয়ারিং, ফ্যাকাল্টি অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্স, ফ্যাকাল্টি অব সায়েন্স এবং ফ্যাকাল্টি অব মডার্ন বিজনেস টেকনোলজি চালু করতে চাই।’
নিজে বিশ্বের ৪০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় ভিজিট করেছেন জানিয়ে অধ্যাপক কাজী সাইফুদ্দীন বলেন, ‘বিদেশি পাঁচটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছি। আমার জীবনে কিছু পাওয়ার নেই। আল্লাহর কাছে সময় চাই। পিরোজপুরে বিশ্বমানের একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমার পরিকল্পনা ব্যাপক। তিনি বলেন, ‘ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, কোরিয়ার অনেক অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরেছি। কাজ করেছি। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। আমার স্বপ্ন আছে। বাংলাদেশ সরকারের ভিশন হচ্ছে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানো। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ধরতে হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ধরতে না পারলে বাংলাদেশ দরিদ্রই থেকে যাবে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার প্ল্যানে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাতে প্রয়োজন উচ্চ শিক্ষা পরিকল্পনা। এ জন্য প্রয়োজন হবে দক্ষ জনশক্তি এবং উদ্ভাবনী ব্যবসায় শিক্ষার। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হাইপাওয়ার অ্যাডভাইজরি কমিটি করে তাদের মতামত নিয়ে পরিকল্পনা করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আন্তর্জাতিক শিক্ষা ও গবেষণা এক্সচেঞ্জ সেন্টার থাকবে। আন্তর্জাতিক গবেষণায় অভিজ্ঞ অধ্যাপক এ সেন্টারের দায়িত্বে থাকবেন। আমি চাইব, বিদেশি শিক্ষার্থীর ভর্তির সুযোগ বাড়াতে। বিদেশি প্রফেসরদের ভিজিটর টিচার হিসেবে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা। প্রতিবেশী দেশ ভারতের আইআইটিগুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় বেশ এগিয়ে গেছে। শিক্ষকদের নিয়ে এসে ক্লাস করাতে পারলে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে।’
বশেমুরবিপ্রবিপির উপাচার্য নিযুক্ত হওয়ার আগে অধ্যাপক সাইফুদ্দীন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইফ অ্যান্ড আর্থ সায়েন্স অনুষদের ডিন এবং সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন। এর আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে বাংলা ও ইংরেজিতে তার লেখা ৩২টি গ্রন্থ রয়েছে। ৫০টির বেশি গবেষণা প্রবন্ধ ও ৩২টির বেশি কনফারেন্স প্রসিডিংস রয়েছে তার। এ ছাড়া তিনি ২৩টি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় কাজ করেন।
অধ্যাপক ড. কাজী সাইফুদ্দীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯০ সালে সাইকোলজি বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি জাপানের কোবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০১ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং সাইকোলজিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার পিএইচডি থিসিস যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত নাসার এডিসে প্রকাশিত হয়।
এ ছাড়া তিনি ভিজিটিং সায়েন্টিস্ট হিসেবে ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও ল্যাংকাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়, জাপানের তকুশিমা বিশ্ববিদ্যালয় এবং দক্ষিণ কোরিয়ার হানইয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ে মানব মস্তিষ্কের জটিল শ্রবণ প্রক্রিয়ার ওপর উচ্চ পর্যায়ের গবেষণার কাজ করেছেন। তিনি জাপানের বিখ্যাত মিতসুবিসি হিউম্যান ইঞ্জিনিয়ারিং ল্যাব, নারা সায়েন্স সিটি ওয়েভ ইঞ্জিনিয়ারিং ল্যাব এবং ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড ল্যাবে গবেষণামূলক কোর্স করেছেন। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় জার্নাল অব সাইকোলজির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদকসহ ৯টি জার্নালের সম্পাদনা পর্ষদে কাজ করেছেন। লেখক ও টেলিভিশন টকশো ব্যক্তিত্ব এ শিক্ষক ২০০৮ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য সচিব, ২০১২ সালে সাধারণ সম্পাদক এবং ২০১৬ সালে সভাপতি নির্বাচিত হন। এ ছাড়াও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় ফেডারেশনের সদস্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আওয়ামী লীগ সমর্থিত নীল দলের সভাপতি, বাংলাদেশ মনোবিজ্ঞান সমিতির সহ-সভাপতি ও ট্রেজারার এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি পদে রয়েছেন। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের শিক্ষা ক্যাডার হিসেবে রাজশাহী কলেজ, তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ, ইডেন কলেজ, বদরুন্নেসা কলেজ, সিলেট এমসি কলেজ ও আইডিয়াল কলেজে শিক্ষকতা করেন।