ই-পেপার শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪

সনদ নেই অনেক মুক্তিযোদ্ধারও
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২২, ১০:০৫ এএম  (ভিজিট : ২৩১)
মার্চের প্রথম দিকেই ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয় কুষ্টিয়ায়। তারপর কুষ্টিয়া হাইস্কুলের মাঠে সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু হয় ডামি রাইফেল দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের যে প্রাথমিক প্রস্তুতি পর্ব, সেটা আমরা ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বেশ জোরেশোরেই নিয়েছিলাম। ৭ মার্চের পরে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বপ্রস্তুতি কুষ্টিয়ায় বেশ ভালোভাবেই হয়। এরপর পাকিস্তনি-আর্মি কুষ্টিয়ায় আসে। 

কুষ্টিয়া জেলা স্কুল, ওয়ারলেস সেন্টার এবং পুলিশ লাইন-এ তিন জায়গায় ওরা অবস্থান নেয়। কুষ্টিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী অসম্ভব ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মূল যুদ্ধটা জেলা স্কুলে হয়েছিল। জেলা স্কুলের ভেতরে পাকিস্তানি আর্মি। হাজার হাজার লোক ঢাল, সড়কি, লাঠি, রামদা নিয়ে পাকিস্তানি আর্মির সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসেছে। এ যুদ্ধে সে সময়ের ইপিআর খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল এবং তাদের সঙ্গে ছিল পুলিশও। জনগণ তো ছিলই। আমরা পরে গিয়ে দেখলাম জেলা স্কুলের আমবাগান ও অডিটরিয়ামের ভেতরে পাকিস্তানি সেনাদের অনেক লাশ পড়ে আছে। এটা এপ্রিলের ঘটনা। পাকিস্তানি সেনাদের যারা বেঁচে গেল তারা যশোর ক্যান্টনমেন্টে পালিয়ে যাচ্ছিল। এরপর খুব নৃশংস হয়ে ওঠে পাকিস্তনি আর্মি। বোমা পড়ল সার্কিট হাউসে এবং অন্যান্য জায়গায়। তাতে আমাদের প্রতিরোধযুদ্ধটা ভেঙে গেল।

প্রতিরোধযুদ্ধে আমরা সহায়ক হিসেবে ছিলাম। আমি তখন অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ তখনও পুরোপুরি শুরু হয়নি-হবে মনে হয় মার্চের ২৬-২৭ তারিখ।

আমাদের ওখানে একজন অবাঙালি এডিসি ছিলেন। তার নাম সৈয়দ জাভেদ আখতার বোখারি। তাকে এবং কুষ্টিয়া পৌরসভার ভাইস-চেয়ারম্যান নবীবক্স বলে আরেক বিহারিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে হত্যা করা হয়। তার আগে ২৫ মার্চ রাতে আমি একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। সার্কিট হাউসসংলগ্ন যে লন্ টেনিস কোর্ট আছে ওখানে স্টেজ করে আমরা অনুষ্ঠান করি। সেই অনুষ্ঠানে কুষ্টিয়ার সেই সময়ের নামকরা শিল্পীরা গান করেছিলেন। আমি সেখানে বক্তৃতা দিই। 

আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ-নেতাদের নাম তো স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানি আর্মির তালিকায় থাকবে। কুষ্টিয়া শহরের তখন পতন ঘটেছে। তখন আরেকটা মারাত্মক ঘটনা ঘটল-যাতে যেকোনো মুহূর্তে মৃত্যু হতে পারত। আমাদের দুটি দোনলা বন্দুক ছিল। আমি এবং আমার বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ বাহাউদ্দিন আহমেদ আমাদের বাড়ির পেছন দিয়ে বাবার বন্দুকটা নিয়ে আমাদের পুরোনো বাড়িতে যাচ্ছি। যদি কেউ আসে বন্দুক দিয়ে প্রতিহত করা হবে। একেবারে ছেলেমানুষি বুদ্ধি! আমরা পেছন দিয়ে যাচ্ছি। বাড়ির পাশেই পেট্রোল পাম্প। হঠাৎ দেখি যে পাকিস্তানি আর্মির চার-পাঁচটা কনভয় পেট্রোল পাম্পে ঢুকল তেল নেওয়ার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে আমরা বন্দুক নিয়ে উলুখড়ের মধ্যে শুয়ে পড়লাম। তারা তেল নিয়ে চলে গেল। তারা দেখলে সেদিন আমাদের দুজনকে যে মেরেই ফেলত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তারপর ভারতে পাড়ি দিলাম।


কৃষ্ণনগর বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটা খুব বড় গ্যারেজ ছিল, শঙ্করবাবুর মোটর গ্যারেজ। সেই ঘরে আমাদের একটা অফিস চালু হলো, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক অফিস। তাতে আমরা কয়েকজন পালা করে কাজ করতাম। আমাদের প্রধান কাজ ছিল দুটি। প্রথমত, যেসব শরণার্থী বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে এসেছে, একটা ছাপানো ফর্মে তাদের নামধাম লিখে সই-স্বাক্ষর করে সিল মেরে দিলে ওরা রেশন-সুবিধা পেত। কৃষ্ণনগরেই আমাদের একটা সরকারি অফিসও ছিল। ওখানে আমাদের এমপিএ আবদুর রউফ চৌধুরী এবং কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক শামসুল হকের নেতৃত্বে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সরকার অনুমোদিত অফিস। তবু আমাদের অফিসই অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের ওই অফিসের কাগজপত্রগুলো আমার সংগ্রহে আছে। সেগুলো মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবান দলিল।

সেই খাতাটা আমার কাছে এখনও আছে। এই খাতা প্রমাণ দেয় কে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আর কে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন যাদের কোনো সনদ নেই; কিন্তু তারা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমাদের এ খাতাটা কিন্তু এ বিষয়ে কিছুটা প্রমাণ দিতে পারবে।




সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close