পানের গ্রাম ছয়ঘরিয়া
সুদীপ্ত শামীম, গাইবান্ধা
|
![]() সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের চারপাশে যেদিকে চোখ যায় কেবলই পানের বরজ। কৃষকরা পানের বরজের পরিচর্যা করছেন, বরজ থেকে পান সংগ্রহ করে বাড়ির উঠানে এনে স্তূপ করে রাখছেন। সেখানে পরিবারের সদস্যরা পানগুলো বাছাই করে রাখছেন। গ্রামটিতে বর্তমানে সাড়ে তিনশটি পানের বরজ রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, পান চাষের জন্য উপযুক্ত উঁচু জমি। জমি তৈরির পর চারদিকে বেড়া ও উপরে ছাউনি দিতে হয়। তারপরে পানের ডাল (বর) রোপণ করতে হয়। পানগাছ উপরে বেয়ে উঠলে মাস খানেক পর শলা দিয়ে দিতে হয়। ৫০-৬০ দিন পর পানগুলো বিক্রি করা যায়। পরিচর্যা ভালো হলে একটি বরজ ৮-১০ বছর বেঁচে থাকে। তারা আরও জানান, ছয়ঘরিয়া গ্রামটিতে ভোটার সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৭০০ জন। ছোট-বড় সবমিলে মোট ৩৫০টি পানের বরজ আছে। ১৯৯৮ সালের আগ পর্যন্ত এ এলাকায় দেশি পানের চাষ হতো। কিন্তু প্রতিযোগিতার বাজারে সেই পান টিকতে পারেনি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল এলাকায় নদী ভাঙন। এ কারণে টানা পাঁচ বছর পান চাষ হয়নি এই এলাকায়। পরে ২০০৩ সালের দিকে তালতলি ও বিক্রমপুরি এ দুই জাতের পান দিয়ে আবারও পান চাষ শুরু হয়। তালতলি পানের বর সংগ্রহ করা হয় রাজশাহী জেলার দুর্গাপুর উপজেলার মোহনপুর থেকে। আর মুন্সিগঞ্জ থেকে বিক্রমপুরি পানের বর সংগ্রহ করা হয়। এলাকার চাহিদা মিটিয়ে এ পান এখন রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, বগুড়া, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। ৬০ বছর বয়সী বৃদ্ধ পান চাষি মো. লাল মিয়া বলেন, এ এলাকায় কবে থেকে পানের আবাদ শুরু হয়েছে জানি না। তবে দাদার আমল থেকে সবাইকে পানচাষ করতে দেখে আসছি। নিজেও করেছি। এবারে মাত্র ৫ কাঠা জমিতে পানের বর লাগিয়েছি। মাটি, বাঁশ, কাশিয়া ও জুনসহ সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। এখন আর কাজের লোক পাওয়া যায় না। সে কারণে পান চাষ কমিয়ে দিয়েছি। মেয়ে দুটিকে বিয়ে দিয়েছি। বড় ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ছোট ছেলে স্থানীয় এক কলেজে পড়ছে। ছেলে দুটোর গতি হলেই এসব ছেড়ে দিব ভাবছি। একই গ্রামের মোছা. মমিনা বেওয়া জানান, কয়েক বছর আগে তার স্বামী মারা গেছে। পান বিক্রি করেই তিনি মেয়ে দুজনের বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে দিনাজপুর হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেজো ছেলে গাইবান্ধা সরকারি কলেজে অনার্স ও ছোট ছেলে এবার এসএসসি দিয়েছে। বসতবাড়িসহ মোট জমি ৪০ শতাংশ। এর মধ্যে ১৭ শতাংশে পান লাগিয়েছেন। সপ্তাহে এক গাদি করে পান তোলা যায়। সপ্তাহে ৪-৫ হাজার টাকার পান বিক্রি হয়। আরেক পান চাষি আমজাদ হোসেন বলেন, পানের বরজ থেকে সারা বছর পান সংগ্রহ করা যায়। শীতকালে পান পাতা বাড়ে কম। যার ফলে শীতকালে তুলনামূলক কম পান উৎপাদন হয়। তবে এ সময় উৎপাদন কম হলেও বাজারে পানের দাম বেশি থাকে। তবে পানচাষিরা অভিযোগ করেন, তারা কৃষি বিভাগের কাউকে চেনেন না। প্রয়োজনে ফোন করলেও তাদের দেখা পাওয়া যায় না। পানের বরজে সবচেয়ে বেশি টিএসপি সারের প্রয়োজন হয়। সেই টিএসপি সারও পাওয়া যায় না। পান চাষকে টিকিয়ে রাখতে হলে টিএসপি সারের দাম কমানোসহ পর্যাপ্ত সরবরাহের ব্যবস্থা করার দাবি জানান পান চাষিদের। স্থানীয় উজান তেওড়া টিইউএম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নুরুন্নবী সরকার বলেন, ‘পান চাষ করে ছয়ঘরিয়া গ্রামের মানুষ স্বাবলম্বী হয়েছে। এই পান স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণ করে জেলার বাহিরেও যায়। পান চাষের আবাদ ধরে রাখলেই পিছনে আর ফিরে তাকাতে হবে না ছয়ঘরিয়া বাসীকে।’ সুন্দরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. রাশিদুল কবির বলেন, দিন দিন এ উপজেলার পান চাষ বাড়ছে। অন্যান্য ফসল আবাদের তুলনায় পান চাষ লাভজনক। তাই কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে আমরা কৃষকদের উৎসাহিত করে থাকি। পানের ফলন ভালো করার জন্য আমাদের মাঠকর্মীরা সার্বক্ষণিক কৃষকদের সহযোগিতা করেন। /জেডও
|