আমি রোনাল্ড রিগ্যান। আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। কিন্তু আপনাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা পেলে কে এটা সবাই জানে। পেলের সম্মানে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে কথাগুলো বলেছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান।
প্রীতি ম্যাচ খেলার অংশ হিসেবে ১৯৬৭ সালে নাইজেরিয়া সফরে গিয়েছিল সান্তোস। বলাবাহুল্য দুনিয়াজুড়ে তখন পেলে। ওই সময় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ চলছিল আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ায়। দেশটির স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াকুবু ও বিদ্রোহী ওজুকর মধ্যকার এই ভয়াল যুদ্ধে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় দেশটিতে। এরই মধ্যে লাগোস বিমানবন্দরে আসেন পেলেরা। এরপর যা ঘটল তাকে কী বলা যায়? পেলের সম্মানার্থে ৪৮ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় দুই পক্ষ।
কতটা দেশ কালের সীমানা পেরোলে একজন পেলে হওয়া যায়!
এবারের বিশ্বকাপের সবচেয়ে সুন্দর গোল করার রূপকার তরুণ ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার রিচার্লিসন তার শোকবার্তায় বলেছেন, ‘একটা অসাধারণ সুন্দর অধ্যায়ের সমাপ্তি। যিনি বদলে দিয়েছেন ইতিহাস সর্বোপরি দর্শন।’ পেলেকে ফুটবলের রাজা হিসেবে অভিহিত করেছেন সবে শেষ হওয়া বিশ্বকাপের গোল্ডেন বুট জয়ী কিলিয়ান এমবাপে। একই সঙ্গে প্রজন্ম পরম্পরায় তাকে অনুসরণ করেই এগিয়ে চলেছে ফুটবল।
কী করেছেন পেলে, প্রশ্নটাই অবান্তর। যুগ যুগ ধরে ফুটবলকে ঘিরে মানুষের যে আবেগ সেটা যার হাত ধরে তাকে মানুষ ভুলবে কীভাবে? মানুষ ফুটবলের দেশ বলতে বোঝে ব্রাজিলকে। সুন্দর ফুটবলের বিজ্ঞাপন আর ব্রাজিল যে সুতোয় গাঁথা। শুধু এটুকু বললে মোটেও সুবিচার করা হবে না পেলের প্রতি।
ফুটবলপিয়াসীদের আকর্ষণের কেন্দ্রে যে লাতিন ফুটবল তার মূলেও যে ‘কালো মানিক’। একমাত্র ফুটবলার হিসেবে তিন তিনবারের বিশ্ববিজয়ী এসব পরিসংখ্যান খুবই তুচ্ছ হয়ে যায় যখন ব্যক্তিটির নাম পেলে।
১৯৫০ সালে ঘরের মাটিতে বিশ্বকাপ জিততে পারল না ব্রাজিল। শোক আর হাহাকার দেশজুড়ে। বিশ্বকাপ জিততে না পেরে অনেকের মতোই কেঁদেছিলেন পেলের বাবা। পেলের বয়স তখন মোটে ৯ বছর। বাবাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, বাবা কেঁদোনা, আমি তোমাকে বিশ্বকাপ এনে দেব। এর ৮ বছর পর বাবাকে দেওয়া কথা রেখেছিলেন ১৭ বছর বয়সি পেলে।
ফুটবলে যে শিরোপার বাইরে আরও কিছু থাকে সে জায়গাটিকেই নতুন করে চেনালেন পেলে। মোৎসার্টের সুর, ভ্যানগগের চিত্রকর্ম কিংবা শেক্সপিয়ারের নাটকের সংলাপের মতোই ফুটবলের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যের বশ হয়ে গেল মানুষ। পেলের ছোঁয়ায় বদলে গেল ফুটবলের দর্শন।
মাঠ কাঁপানো এমবাপে, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, তরুণ রিচার্লিসন কিংবা ১৯৬০ দশকের বিশ্বকাপজয়ী জিওফ হার্স্টরা সবাই পেলেকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বারবার ব্যবহার করেছেন ‘লিগ্যাসি’ শব্দটি। তাদের মূল কথা, আজকের ফুটবলে যে রমরমা অবস্থা সেটা আসলে পেলের এনে দেওয়া লিগ্যাসির ওপরই দাঁড়িয়ে আছে।
রাজা আসে রাজা যায়, এটাই ইতিহাসের গতিধারা। কিন্তু কেউ কেউ হয়ে ওঠেন রাজাদেরও রাজা। পর্তুগীজ সেনসেশন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো পেলেকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে সম্বোধন করেছেন ‘চিরন্তন রাজা’ হিসেবে। পেলে শাশ্বত, অব্যয় অনুপম এভাবেই নিজের আবেগ প্রকাশ করেছেন ২০০২ বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিলের কিংবদন্তি ডিফেন্ডার কাফু। তার ভাষায়, ‘পেলে মারা গেছেন এটা সঠিক সংবাদ নয়। পেলে শাশ্বত। পেলে রাজা। পেলেরা কখনো মরে না।’
সব রাজা অমরত্ব ঠিকানায় পৌঁছতে পারেন না। অমরত্বের সান্নিধ্য পায় রাজাদের রাজারাই। পেলে তার ক্লাব ক্যারিয়ার শেষ করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের কসমস ক্লাব থেকে। এই ক্লাবের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আমেরিকায় ফুটবল বিপ্লব শুরু করেন পেলে।