এবার মেট্রোরেল হবে চট্টগ্রামেও। চট্টগ্রাম শহরের সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থাপনা ও মেট্রোরেল নির্মাণসহ পরিকল্পিত গণপরিবহন ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার লক্ষ্যে আগ্রহ প্রকাশ করেছে দক্ষিণ কোরিয়া।
মেট্রোরেলের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ৬০ লাখ ডলারের অনুদানও দিচ্ছে কোরিয়ান আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা (কোইকা)। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ৬২ কোটি টাকা। অনুদানের এ অর্থ দিয়ে ট্রান্সপোর্ট মাস্টার প্ল্যান অ্যান্ড প্রিলিমিনারি ফিজিবিলিটি স্টাডি ফর আরবান মেট্রোরেল ট্রানজিট কনস্ট্রাকশন অব চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এরিয়া শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানিয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)।
এ বিষয়ে ইআরডি ও কোইকার মধ্যে রেকর্ড অব ডিসকাশন ও টার্মস অব রেফারেন্স চুক্তি সই হয়েছে। গত ৮ ডিসেম্বর রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে ইআরডি সম্মেলন কক্ষে এ চুক্তি সই হয়। চুক্তিতে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নূরী, ইআরডির অতিরিক্ত সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী এবং কোইকার আবাসিক প্রতিনিধি ইয়াং আ দো সই করেন।
ইআরডি জানায়, এ সমীক্ষায় চট্টগ্রাম শহরের সুশৃঙ্খল পরিবহন ব্যবস্থাপনার জন্য একটি পরিবহন মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে। এর আওতায় যানজটমুক্ত সড়ক ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, চট্টগ্রামে নগরকেন্দ্রিক পরিবেশবান্ধব মেট্রোরেল নির্মাণ এবং চট্টগ্রামে অবস্থিত পরিবহন খাতে নিজস্ব সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হবে।
পরে এ মহাপরিকল্পনার আলোকে কোরিয়া সরকারের সহায়তায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের সম্ভাবনার কথাও জানানো হয়। যা ইতিবাচকভাবে নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে ভাবছে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব কর্তৃপক্ষ (পিপিপিএ)।
পিপিপিএর মহাপরিচালক আবুল বাশার বলেন, মেট্রোরেল নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার এই আগ্রহ ইতিবাচক। এখন পরবর্তী করণীয় বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে চিঠি পাঠানো হবে। পিপিপি প্ল্যাটফর্মে জি টু জি (গর্ভমেন্ট টু গর্ভমেন্ট) পদ্ধতিতে কাজ করতে হলে সে দেশের পক্ষ থেকে আগ্রহ প্রকাশ করতে হয় বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, এখন ঢাকায় মেট্রোরেলের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ডিএমটিসিএলকে (ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড) এই আগ্রহের বিষয়ে জানানো হবে। এ বিষয়ে তাদের পরামর্শ নেওয়া হবে।
এরপর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দক্ষিণ কোরিয়াকে জানানো হবে কোন সংস্থা এ বিষয়ে দায়িত্ব পালন করবে। তখন তারা ওই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করবে এবং সে দেশের বিনিয়োগকারী নির্বাচন করবে। এটাই প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়াতে পিপিপি প্রকল্প আগায়।
এ প্রস্তাবের আগে গত ৭ ফেব্রুয়ারি উন্নয়ন সংস্থা কোইকার মাধ্যমে মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে নিজেদের আগ্রহের কথা জানিয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া। তখন এ কাজে তারা ৫০ লাখ ডলার অনুদান হিসেবে দিতে চেয়েছিল। এবার তারা প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিল।
পিপিপিএর মহাপরিচালক বলেন, কোনো প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে এর দৈর্ঘ্য, খরচ, কোন কোন পথে যাবে, কত বছরে নির্মাণ হবে, এসব বিষয় নির্ধারিত হয়। সম্ভাব্যতা যাচাই হলেই বলা সম্ভব কীভাবে হবে, কী হবে।
এর আগে চীনের চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি নিজেদের খরচে চট্টগ্রামে মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নের একটি প্রস্তাব দেয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (চউক)। বিনিময়ে মিরসরাইয়ের কাছে সাগর থেকে
উদ্ধার করা ৬০ বর্গ কিলোমিটার জমিতে তারা একটি স্মার্ট সিটি বানিয়ে সেখান থেকে লভ্যাংশ নেওয়ার প্রস্তাব করে। পাশাপাশি মেট্রোরেল প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইও নিজেদের খরচে করার প্রস্তাবও দেয় চীনা কোম্পানিগুলো। চউক প্রস্তাবের বিষয়টি জানানোর পর গত ২২ ফেব্রুয়ারির বৈঠকে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানোর সুপারিশ করে।
এ ছাড়া গত ১৩ জানুয়ারি ঢাকায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে এক বৈঠকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে চায়না রেলওয়ে কন্সট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিআরসিসিএল) চট্টগ্রামে মেট্রোরেল নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের আগ্রহ প্রকাশ করেছিল।
মেট্রোরেল নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ২০১৯ সালের জুলাইয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাসস্থান ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড কনসালট্যান্টস লিমিটেডের মাধ্যমে একটি প্রাক-যোগ্যতা সমীক্ষা করেছিল। ওই প্রতিবেদনে বন্দরনগরীতে মেট্রোরেলের তিনটি র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইনের প্রস্তাব করা হয়, যাতে ব্যয় ধরা হয় আনুমানিক ৮৬ হাজার কোটি টাকা।
তবে নগরীর জনবহুল কয়েকটি অংশে মাটির নিচ দিয়ে মেট্রোরেল নেওয়ার প্রস্তাবও আসে ৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত এ সংক্রান্ত এক সভায়। এতে খরচ কয়েকগুণ বাড়তে পারে বলে জানানো হয়। সভায় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ফিজিবিলিটি স্টাডি শেষ করে আগামী বছরের শুরুতে যেন প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামে মেট্রোরেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে পারেন সে লক্ষ্যেই কাজ চলছে। প্রধানমন্ত্রী দুই-আড়াই বছর আগে যোগাযোগমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করেছেন এটা করার জন্য।
হাছান মাহমুদ বলেন, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু টানেল থেকে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় পর্যন্ত মেট্রোরেল যেতে পারে। এ ছাড়া মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর পর্যন্ত কীভাবে মেট্রোরেল নিয়ে যাওয়া যায় এসব বিষয় মাথায় রেখেই পরিকল্পনা করা উচিত। এর ইঞ্জিনিয়ারিং প্ল্যান করবে কোরিয় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (কোইকা)। ফিজিবিলিটি স্টাডি করে যাতে এক বছর পর প্রধানমন্ত্রী মেট্রোরেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে পারেন, সে লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।
বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগরী থেকে কিছুটা দূরে মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্প নগর, কর্ণফুলী টানেল, টানেলের ওপারে প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর ও জ্বালানি হাব ঘিরে ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে চট্টগ্রামে দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের আনাগোনা বাড়বে।
সেসব বিষয় মাথায় রেখে গত ৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে চট্টগ্রামেও মেট্রোরেল নির্মাণের নির্দেশ দেন। পরে নগরীতে তিন থেকে চারটি রুটে মেট্রো রেল করে এ নেটওয়ার্কে মিরসরাই শিল্প নগর, বিভিন্ন শিল্প এলাকা ও নগরীর উপকণ্ঠের গ্রোথ সেন্টারগুলোকে সংযুক্ত করার পরামর্শ আসে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে।