ই-পেপার মঙ্গলবার ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪
মঙ্গলবার ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

২০২২ সালের শিক্ষা
আমাদের কীভাবে সাহায্য করবে
প্রকাশ: শনিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২, ৯:১৪ এএম আপডেট: ০১.০১.২০২৩ ৭:২৭ এএম  (ভিজিট : ৪৬৫)
২০২৩ সালে বিশ্ববাসীর জন্য কী ধাক্কা অপেক্ষা করে আছে? বিগত বছরগুলোতে ঘটা বিভিন্ন বিস্ময়কর ঘটনার কথা স্মরণ করুন। চিন্তা করে দেখুন কীভাবে এসব ঘটনা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছে। এ ক্ষেত্রে ব্রেক্সিট, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়, উপসাগরীয় সংকট, কোভিড-১৯ মহামারি, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনকে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়।

২০২২ সালে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার কথা বিবেচনা করে দেখুন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট ২৪ জুন ‘রো বনাম ওয়েড’ রায়কে বাতিল করে দেয়। এটি ছিল ১৯৭৩ সালের রো বনাম ওয়েড মামলার রায়। ১৯৭৩ সালের সেই রায়ে গর্ভপাতকে একটি সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া লিজ ট্রাস যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মাত্র ৪৪ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। যুক্তরাজ্যের আর কোনো প্রধানমন্ত্রীর ভাগ্যে এত সংক্ষিপ্ত মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড নেই। বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণের মধ্যে তার আর্থিক পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ওঠার পর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি।  

এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা বিশ্বজুড়ে মানুষকে বিগত বছরগুলোর মতোই ২০২২ সালেও একই রকম ভোগান্তিতে ফেলেছিল। চরম আবহাওয়া, ইউরোপ এবং পাকিস্তানে বন্যা থেকে শুরু করে উত্তর আমেরিকায় ‘শতাব্দীর ভয়াবহ তুষারঝড়’ চলতি বছর বিশৃঙ্খলা, মৃত্যু ও ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।  

এদিকে ইরানে ২২ বছর বয়সি মাহসা আমিনির গ্রেফতারের পর মৃত্যু, দেশজুড়ে বিক্ষোভের বিশাল ঢেউ ছড়িয়ে দিয়েছে। ঠিকমতো হিজাব না পরার কারণে ইরানের নৈতিকতা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছিল। ১৬ সেপ্টেম্বর পুলিশ হেফাজতে মারা যান কুর্দি এই তরুণী। এরপরই হিজাববিরোধী বিক্ষোভে নেমে পড়েন ইরানিরা। বর্তমানে এই বিক্ষোভ সরকারবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, মাহসা আমিনিকে কেন্দ্র করে ইরানে এ পর্যন্ত শতাধিক নিহত হয়েছে এবং অন্তত ১৪ হাজার গ্রেফতার হয়েছে। 

২০২২ সালে জ্বালানি সংকটের কারণে বিশ্বজুড়ে এর দাম বেড়েছে। ফলে চাপে পড়েছেন ভোক্তা, ব্যবসায়ী এবং সরকার। এ কারণে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। 

লেবানিজদের জন্য ২০২২ সাল সুখকর ছিল না। বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ২৭টি ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এটি একটি রেকর্ড ছিল। অবশ্য এটিকে প্রচলিত ব্যাংক ডাকাতির সঙ্গে তুলনা করা যায় না। কারণ আমানতকারীরা নিজেরাই নিজেদের টাকা উঠিয়ে নেওয়ার জন্য আইন নিজ হাতে তুলে নিয়েছেন। তারা নিজেদের অ্যাকাউন্টের অর্থ তুলে নেওয়ার জন্য ডাকাতির আশ্রয় নিয়েছেন। অস্ত্র হাতে ব্যাংকে প্রবেশ করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে ২০১৯ সাল থেকেই তীব্র অর্থনৈতিক সংকট চলছে। যতই দিন যাচ্ছে অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটছে না। এর মধ্যেই ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের অর্থ তোলার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। ফলে প্রতিদিন ৪০০ ডলারের বেশি অর্থ তুলতে দেওয়া হচ্ছে না গ্রাহকদের। এরই প্রেক্ষাপটে আমানতকারীরা জমাকৃত সঞ্চয়গুলো তুলে নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। 

অবশেষে লিওনেল মেসির বিশ্বকাপ জয়ের মাধ্যমে সুন্দর সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে ২০২২ সালের। মধ্যপ্রাচ্যের ছোট কিন্তু ধনী দেশ কাতারে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে ফ্রান্সকে টাইব্রেকারে পরাজিত করে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের শিরোপা জয় করে লাতিন আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা। যদিও টুর্নামেন্টের শুরুতে সৌদি আরবের কাছে বিস্ময়কর পরাজয়ের পরেও নিজেদের লক্ষ্যে স্থির থাকতে পেরেছিল মেসির নেতৃত্বাধীন দলটি। আর ১৮ ডিসেম্বর রাতে বহুল আকাক্সিক্ষত সোনালি ট্রফি হাতে ৩৬ বছরের শিরোপা খরা কাটাতে সক্ষম হন তারা।  

উল্লিখিত ঘটনাগুলো ২০২২ সালে ঘটেছে। ২০২১ সালে বছরের শেষ সময়ে এসে কেউ এ ধরনের ঘটনা ঘটবে, এই ভবিষ্যদ্বাণী নিশ্চয়ই করতে পারতেন না। এই ঘটনাগুলো আমাদের বেশিরভাগকেই অবাক করে দিয়েছিল। আমরা অনেকেই এসব ঘটনায় ধাক্কা খেয়েছি। তবে গত বছরের ঘটনার আলোকে আগামী বছরে কী ঘটবে সে বিষয়ে পূর্বাভাস দেওয়া যেতেই পারে। এটা জরুরি না যে সব ভবিষ্যদ্বাণী ফলে যাবে। এই বছর যা ঘটেছে সেগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে আগামী ১২ মাস আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে তার কিছুটা হলেও আন্দাজের চেষ্টা করা যায়। 

জলবায়ু সন্ত্রাসের আশঙ্কা দিয়ে শুরু করা যাক। আমরা ফ্রান্সে দেখেছি একটি সিমেন্ট কারখানার গ্রিন হাউস গ্যাসের উচ্চ নির্গমনের জন্য অ্যাক্টিভিস্টরা নাশকতা করেছেন। লন্ডনের ন্যাশনাল গ্যালারিতে ভিনসেন্ট ভ্যান গগের বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘সানফ্লাওয়ারস’-এর ওপর টমেটোর স্যুপ নিক্ষেপ করেছিলেন জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলনের কর্মীরা। ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শহরগুলোতে স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকল বা এসইউভি গাড়ির টায়ার পাংচার করে দেওয়া হচ্ছে। জার্মানিতে জলবায়ু আন্দোলনের কর্মীরা বার্লিনে ১৫ মিটার উচ্চতার একটি ক্রিসমাস ট্রির ওপরের অংশ কেটে ফেলেছেন। এ ছাড়া মোটরওয়ে, প্রধান শহরের রাস্তা এবং বিমানবন্দর অবরোধ করা, বিভিন্ন কাঠামোর সঙ্গে গ্লু দিয়ে নিজেদের আটকে দেওয়া তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজে পরিণত হয়েছে। জলবায়ু সংকটের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এবং শক্তিশালী সরকারি পদক্ষেপের আহ্বান জানানোর জন্য তারা এসব কাজ করে থাকেন। এসব কর্মকাণ্ড জলবায়ু আন্দোলন নিয়ে প্রতিবাদ চক্রের শুরু মাত্র। 

সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটির হিউম্যান ইকোলজির সহযোগী অধ্যাপক এবং ‘হাউ টু ব্লো আপ আ পাইপলাইন’-এর লেখক আন্দ্রেয়াস মালম এ বিষয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করেছেন। তিনি মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গকে জানিয়েছেন, জলবায়ু আন্দোলকর্মীরা ভবিষ্যতে আরও চরম পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। আন্দ্রেয়াস মালম বলেন, ‘জলবায়ু আন্দোলনের প্রথম কাজ হলো মানুষের কাছে পরিষ্কার করা যে নতুন পাইপলাইন ও নতুন গ্যাস টার্মিনাল নির্মাণ করা, নতুন তেল ক্ষেত্রের সন্ধান করা সহিংসতামূলক কাজের মধ্যেই পড়ে। অচিরেই এগুলো বন্ধ করা দরকার। কারণ এর মাধ্যমে মানুষের অস্তিত্ব ধ্বংসের মুখে পড়ে যায়।’ 

এরপর বিভিন্ন দেশে ক্রমবর্ধমান ধর্মঘটের মাত্রা সম্পর্কে ভাবতে হবে। গণমাধ্যমে প্রায় সময়ই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক, শিক্ষক, চালকদের বেতন বাড়ানোর জন্য ধর্মঘটের কথা শোনা যায়। যুক্তরাজ্যে সর্বশেষে ড্রাইভিং পরীক্ষকরা বেতন নিয়ে ধর্মঘট শুরু করেছেন। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তারা ধর্মঘটে যেতে বাধ্য হয়েছেন। চিকিৎসক ও নার্সরাও ধর্মঘটে অংশ নিচ্ছেন। মুদ্রাস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক মন্দার ফলে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন পেশার মানুষ ধর্মঘটে যাওয়াকে একমাত্র অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন। দিনে দিনে এই প্রবণতাটি ইউরোপজুড়ে এবং সম্ভবত এর বাইরেও ছড়িয়ে পড়তে চলেছে। ২০২৩ সালে আরও নতুন নতুন পেশার মানুষ ধর্মঘটে যোগ দেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে সরবরাহ চেইন আরও ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

এ ছাড়া ২০২৩ সালে বড় কোম্পানির ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কাও আছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পূর্বাভাস দুর্বল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক সাবেক বিনিয়োগকারী আরও হতাশ হয়েছেন। এ ছাড়া প্রতিনিয়ত ব্যবসার মডেলগুলো দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটছে। ফলে নতুন বছরে বিশাল কোনো কোম্পানির পতন আমাদের মধ্যে বিস্ময়ের সৃষ্টি করতে পারে। এ ছাড়া প্রযুক্তি খাতেও নিত্যনতুন পণ্য বাজারে আসতে পারে। যদিও আইফোনের পর থেকে প্রযুক্তি আমাদের খুব বেশি বিস্মিত করতে পারেনি। 

আগামী বছর ফুটবলবিশ্বে কি নতুন কোনো পরিবর্তন আসতে পারে? ইউরোপীয় দেশগুলোতে অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব ফুটবল ক্লাবগুলোতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ৩০ বছর আগে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ গঠন করার পর থেকে এটি কেবল বড় হয়ে উঠেছে। এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক সব সমস্যা থেকে নিরাপদ রয়েছে এই লিগ। আমেরিকান ব্যবসায়ী বিল ফোলি সম্প্রতি বোর্নমাউথ ফুটবল ক্লাব কিনে নিয়েছেন। এই ঘটনাটিকে অনেকেই প্রিমিয়ার লিগের জন্য ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। তবে ইউরোপের বেশ কয়েকটি বড় ফুটবল ক্লাবে বিচ্ছিন্ন সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো রেঞ্জার্স এবং স্পেনের বার্সেলোনার কথা উল্লেখ করা যায়। বর্তমানে আর্থিক সংকটে জর্জরিত বার্সেলোনা। গত বছর আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে ক্লাবের সেরা খেলোয়াড় লিওনেল মেসিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে একসময়ের ইউরোপসেরা ক্লাবটি। তবে সামগ্রিকভাবে আগামী বছর সম্বন্ধে যেসব পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে তার সবই যে ঘটবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না। যদিও এটি প্রায় নিশ্চিত যে ২০২৩ সালে অনেক বিস্ময় আসতে পারে। ইতিমধ্যেই বিশ্বজুড়ে আরও যুদ্ধ ও সংঘাতের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।

এই বছরের অভিজ্ঞতার পরে, আমাদের সবার খারাপের জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত। তবে ২০২২ সাল শেষ হওয়ার এই মুহূর্তে ২০২৩ সালের জন্য শুভকামনা করা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করণীয় নেই।


দুবাইভিত্তিক পত্রিকা দ্য ন্যাশনালের সরকারী সম্পাদক। অনুবাদ করেছেন ফারহানা করিম চৌধুরী




সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close