প্রকাশ: শনিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২, ৯:১৯ এএম (ভিজিট : ৫৩৬)
পেলের গল্পের শুরুটা বিশ্বকাপ দিয়েই। ১৯৫০ সালে ঘরের মাঠে উরুগুয়ের কাছে বিশ্বকাপ ফাইনাল হারের দুঃখ এখনও কাঁদায় ব্রাজিলিয়ানদের। সেদিন কেঁদেছিলেন ৯ বছরের ছোট্ট পেলেও। খেলা শেষ হওয়ার পর আবেগে ভেঙে পড়েন পেলের বাবা দনদিনিও। হাঁটুর ইনজুরির কারণে যার ফুটবলার হয়ে ওঠার স্বপ্নটাও অকালে শেষ হয়ে গিয়েছিল।
ফুটবলটা পেলের রক্তেই। সেদিন বাবার চোখের জল মুছে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘একদিন আমি এই বিশ্বকাপ এনে দেব। পাড়ার ফুটবলার থেকে পেশাদার ফুটবলার হওয়ার যাত্রাটা তার সেখান থেকেই। তার অসাধারণ প্রতিভা নজরে পড়ে যায় ব্রাজিলের বিখ্যাত ক্লাব সান্তোসের এক কর্মকর্তার। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই তাকে সান্তোসে নিয়ে আসেন তিনি। দ্রুতই সান্তোসের মূল দলে সুযোগ করে নেন পেলে। সেই পারফরম্যান্স তাকে জায়গা করে দেয় ১৯৫৮ বিশ্বকাপে। শুক্রবার সময়ের আলোর প্রথম পাতায় কালো অক্ষরে মাত্র তিনটি শব্দ শিরোনামে ছাপা হয়েছে ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে বড় শোক সংবাদটি, ‘বিদায় ফুটবলের রাজা’। ফুটবল কিংবদন্তি পেলে বৃহস্পতিবার ৮২ বছর বয়সে কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, যাকে ধরা হয় ফুটবল ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে। ব্রাজিলের এক বিখ্যাত ক্রীড়া লেখক বলেছিলেন, ‘মানুষ হিসেবে জন্ম না নিলে, ফুটবল হিসেবে জন্ম নিতেন পেলে।’
কী অবস্থার মধ্যে খেলেছেন পেলে! খেলোয়াড়ি মানসিকতার সবচেয়ে গভীর অবক্ষয়ের কালে তাকে খেলতে হয়েছে, নেতিবাচকতার চূড়ান্ত বিস্ফোরণের সময়ের মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে। কঠিনতম, নীতিহীন ম্যানমার্কিং, হিংস্রতম মারধরের মধ্যে দাঁড়িয়ে তাকে ফোটাতে হয়েছে ফুটবল শিল্পের সুন্দরতম ফুলগুলো। চার-পাঁচজন করে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, বল ছুঁতে দেব না, প্রতিপক্ষের মার খেয়ে অসহায়ভাবে যন্ত্রণায় ককিয়েছেন, রেফারিরা থেকেছেন উদাসীন। আজ ফুটবল অনেক ভদ্র ও সংগঠিত হয়েছে। ষাটের দশকের অন্ধকার অপসারিত। ব্রাজিলে খেলেই কৃষ্ণবর্ণের পেলে পুরো পৃথিবীর কাছ থেকে সর্বকালের সেরা প্লেয়ারের মর্যাদা পেয়েছেন। ফুটবলে কতটা ইম্প্যাক্ট তৈরি করলে, নিজের খেলার পর্যায়টা কতটা উঁচুতে থাকলে ওই সময়ে ব্রাজিলের একজন প্লেয়ার ইউরোপে না খেলেই এ ধরনের খেতাব পেতে পারেন। পেলেই ফুটবলের প্রথম গ্লোবাল স্টার। পেলেকে ইউরোপে খেলতে না দিয়ে ব্রাজিলে রেখে দেওয়ার জন্য চাপ ছিল সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও। ১৯৬১ সালের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জানিও কোয়াদ্রস পেলেকে জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে তাকে রফতানি করা যাবে না বলে একটি ডিক্রি জারি করেছিলেন।
কিন্তু ফুটবলার পেলের কী প্রভাব পড়েছিল ব্রাজিলের সমাজে, সেটা বোঝা যায় পেলের আসল নাম এডসন থেকে। ব্রাজিলের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ভূগোল ও পরিসংখ্যান ইনস্টিটিউটের হিসাবে প্রচুর শিশুর নাম রাখা হয়েছে এডসন। তারা বলছে, গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকে ব্রাজিলে ৪৩ হাজার ৫১১ জনের নাম ছিল এডসন। কিন্তু এর দুই দশক পর, পেলে যখন এক হাজারেরও বেশি গোল করেন এবং তিনটি বিশ্বকাপ জয় করেন, তখন এই নামের মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ১১ হাজারেরও বেশি। ৮২ বছর বয়সে কোলন ক্যানসারে হার মেনেছেন পেলে। বিদায়বেলায় রেখে গেছেন স্ত্রী-সন্তানসহ অনেক শুভানুধ্যায়ী। শুধু স্ত্রী-সন্তানদের নয়, রেখে গেছেন আরও একজন বিশেষ মানুষকে। আর তিনি হচ্ছেন তার জন্মদাত্রী মা ডোনা চেলেস্টে। এতটাই নির্মম সংবাদ যে, এখন নিজের ছেলের মৃত্যুর সংবাদ শুনতে হচ্ছে চেলেস্টেকে। গত মাসে যিনি নিজের ১০০ বছর পূর্ণ করেছেন। কতটা ব্যথা নিয়ে প্রিয় পেলেকে বিদায় দেবেন, তার ভার একমাত্র চেলেস্টেই জানবেন।
ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলের মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান পুরো বিশ্ব। বিশেষ করে ফুটবল বিশ্বে চলছে শোকের মাতম। সাবেক-বর্তমান ফুটবলাররা নিজেদের শোক জানান দিচ্ছেন। পেলের মৃত্যুর খবরে শোক প্রকাশ করাদের মধ্যে আছেন লিওনেল মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, নেইমাররা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রত্যেকেই পেলের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তের ছবি পোস্ট করেছেন।
পেলে অমর থাকবেন তার শ্রেষ্ঠত্বের মাধ্যমে। ফুটবল যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন নেওয়া হবে তার নাম। ইতিহাসের প্রথম ফুটবলার হিসেবে তিনটি বিশ্বকাপ জিতেছেন তিনি- যে কীর্তি আর কেউ ছুঁয়ে দেখতে পারেননি এখন পর্যন্ত। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলাটির ‘অনন্তকালের রাজা’ হয়ে থাকবেন তিনি।