ই-পেপার বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪

পেশাগত উন্নতি বনাম পারিবারিক সহযোগিতা
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২৬ জানুয়ারি, ২০২৩, ৭:৩৯ এএম  (ভিজিট : ২০৩)
মানুষ সামাজিক জীব। পরিবারের মধ্যেই মানুষের সামাজিক জীবনের সূচনা। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে ঘরে, বাইরে থেকে দেশ-দেশান্তরে। যুগে যুগে মানুষ কোনো না কোনোভাবে সামাজিক জীবনযাপন করেছে। প্রাচীনকাল থেকেই পরিবারই সামাজিক জীবনের প্রথম ক্ষেত্র বা প্রথম স্তর হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। এককথায় বলা যায়, বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রের যে গুরুত্ব, প্রাচীনকালে অর্থাৎ মানবতার শৈশবকালে পরিবার সেই একই গুরুত্বের অধিকারী ছিল। ধারাবাহিকতায় এখনও পরিবারকে রাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করা যায়, আবার রাষ্ট্রকে পরিবারের সঙ্গে। 

আমরা পেশা বলতে বুঝি কোনো ব্যক্তি নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ-পরবর্তী জীবিকা নির্বাহের জন্য চাকরি বা অন্য কোনো বৃত্তিবিশেষ, যার মাধ্যমে তিনি বা তারা অর্থ উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করেন। আর সেখানে দরকার দক্ষতা।

নিজেকে একটা ভালো অবস্থানে দেখা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির অংশ। ভালো অবস্থান, বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার প্রত্যাশা সবার থাকে। তবে প্রত্যাশা পূরণের জন্য কিছু অনুষঙ্গ চলে আসে। মেধা, পরিশ্রম ও সততা এই অনুষঙ্গগুলোর মধ্যেই পড়ে। এর সঙ্গে আরও একটি বিষয় লিখিত বা অলিখিতভাবে চলে আসে। সেটি হলো মন বা মনসংক্রান্ত কার্যক্রম। 

মানুষ সবসময় মন দ্বারা পরিচালিত। জীবনের জন্য অপরিহার্য যেকোনো কাজ করতে দরকার মনের নির্দেশনা। মন যদি সঠিক নির্দেশনা না দেয় তাহলে কোনো কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় না। যে মন মানুষকে সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়ে সহায়তা করে সেটিও নির্ভরশীল সামগ্রিক পরিস্থিতির ওপর। তাই পরিবেশ ঠিক থাকলে মন ভালো থাকে এবং মন ভালো থাকলে সঠিক নির্দেশনাও পাওয়া যায়।

যেহেতু মানুষ সামাজিক প্রাণী তাই মানুষের মনের ওপর সমাজ প্রভাব বিস্তার করে। কারণ সমাজ শুরু হয় পরিবার থেকে। তাই মানুষের মনও পরিচালিত হয় পারিবারিক সুখ ও শান্তি দ্বারা। পরিবারে সুখ ও শান্তি বিরাজ করলে মানুষের মনেও সুখ-শান্তি বিরাজ করে।  

প্রতিটি সামজিক মানুষ পরিবার থেকে বের হয়ে কর্মস্থলে যায়, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কাজ করে আবার পরিবারেই ফিরে আসে। যখন পেশাগত দায়িত্ব পালন করে তখন মনের মধ্যে যে বোধটুকু কাজ করে তা হলো পরিবারের জন্যই কাজ করা হচ্ছে। বলা যায় পরিবারই মানুষের কর্মের মূল অনুপ্রেরণা। নারী-পুরুষ সবার ক্ষেত্রে কথাটি প্রযোজ্য। সংসারে যদি শান্তি বিরাজ করে তাহলে সব কাজ সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা যায়। 

আজকাল নারীরা পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঘরে এবং বাইরে কাজ করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীর কাজের পরিমাপ পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে থাকে। কর্মক্ষেত্রের দায়িত্ব পালন ছাড়াও নারীরা জীবনের সব ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে বেশি কাজ করে। একজন পুরুষ অফিস থেকে ফিরে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটায় অথবা ঘরে বসে টিভি দেখে। তার চা-জলখাবারটি তার কাছেই চলে আসে। একজন নারীর পক্ষে তা কখনো হয়ে ওঠে না। ঘরে ফিরেই নারীটি স্বামী-সন্তানের জন্য খাদ্য প্রস্তুত করার কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। সেদিন রাত-পরদিনের খাবার প্রস্তুত করা ছাড়াও সন্তানের পড়াশোনায় সহযোগিতা করতে হয়। বাড়িতে যদি বয়োবৃদ্ধ শ^শুর-শাশুড়ি থাকেন তাহলে তাদের দেখাশোনাও করতে হয়। সব কাজ শেষ করে নারী যখন বিছানায় যায় তখন হয়তো ঘড়ির কাঁটা পরের দিনের ক্যালেন্ডার ছুঁয়ে ফেলেছে, অথচ ঘুম তখনও ছোঁয়নি তার চোখের পাতা। 

এ ছাড়া আমরা জানি পৃথিবীতে প্রথম কৃষিকাজ শুরু করেছিল নারী। তাই বলা যায়, শুধু খাবার প্রস্তুতই নয়, প্রস্তুতি-পূর্ববর্তী কাজটি একসময় নারীর হাত দিয়ে হয়েছিল এবং এখন নারীরা ক্ষেতে-খামারে একই গতিতে কাজ করে যাচ্ছে। সবকিছু বিবেচনাসাপেক্ষে নারী কিন্তু হাসিমুখে সব কাজ করে যায়। কারণ তার কাছে পরিবারের সুখ-শান্তিই মুখ্য বিষয়। 
এতসব কাজের মাঝেও নারীকে তার পেশার ক্ষেত্রে অনেক দক্ষতার পরিচয় দিতে হয়। কারণ কর্মক্ষেত্রে তাকে প্রতিনিয়ত নানা পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। তার যেকোনো সাফল্যকে দেখা হয় অপ্রয়োজনীয় সুবিধাভোগীর দৃষ্টিতে। তার প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর শ্যেন নজর রাখা হয়। কাজের মাঝে পুরুষ যখন দুয়েকটি ধূম্রশলাকা নিঃশেষ করার কাজে সানন্দ সময় ব্যয় করে নারীটি কিন্তু তখনও ঘাড় গুঁজে বসে তার পেশাগত দায়িত্ব পালন করে যায়।

 নারীর অর্জিত প্রতিটি অর্থ সংসারে ব্যয় হচ্ছে এবং স্বচ্ছন্দ্যের রোজনামচায় তা দৃঢ় ভূমিকা রাখছে। তারপরও কিন্তু কোনো কোনো পরিবার থেকে নারীর যোগ্যতাকে স্বীকার করা হয় না। তা ছাড়া নারী যদি তার স্বামীর চেয়ে অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন হয় অথবা উচ্চপর্যায়ের চাকরি করে তাহলে তার সুফলটুকু গ্রহণ করার পরও তাকে প্রতিনিয়ত মানসিক নির্যাতনের মধ্যে দিনাতিপাত করতে হয়। যেন উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন কাজটি তার গর্হিত অপরাধ।

বলা যেতে পারে, সময় এসেছে সব বাধা ঠেলে এগিয়ে যাওয়ার। এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব, এগিয়ে যাচ্ছে নারী। দেশের উন্নয়ন পরিধি বাড়াতে নিজ নিজ কর্মস্থলে দৃঢ়তার স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছে এ যুগের নারীরা। বিশেষ করে করপোরেট জগতের মতো একটি চ্যালেঞ্জিং ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। করপোরেট জগতের বিভিন্ন উচ্চপদের জায়গায় নারীরা তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। যার ফলে এ সেক্টরের শীর্ষস্থানীয় অনেক আসন আজ নারীদের দখলে। যোগ্যতার পরিচয় দিয়েই এ আসনে আসীন হয়েছে নারী। বলা যায়, বিশে^র সব উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশেও নারীরা জেগে উঠেছে। করপোরেট পরিবেশে যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য নারীদের বিশেষভাবে সচেষ্ট হতে হয়। এ ক্ষেত্রে যোগ্যতার পরিমাপক কর্মক্ষমতা নির্দিষ্ট। সুতরাং তারা প্রত্যয়ের সঙ্গে কাজ করতে পারেন। নারীদের কিছু গুণ আছে, যা তাদের সব রকম উপযুক্ত ক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করে। নারীরা সহানুভূতিশীল এবং তারা অর্থপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন। তাদের ভাবের আদান-প্রদানরীতি অত্যন্ত আকর্ষণীয়। তারা কোনো রকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই সবসময় প্রশ্ন করার জন্য প্রস্তুত থাকেন। তারা মতামত, পরামর্শ এবং সাহায্য গ্রহণের জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকেন। তাদের সতর্ক থাকারও একটি প্রবণতা আছে। তারা বোঝার জন্য এবং শেখার জন্য গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। তারা মানুষের দুর্বলতাগুলোর চেয়ে সামর্থ্যকে বেশি বড় করে দেখেন। তারা কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও বেশ সময় নিয়ে চিন্তা করেন এবং যথাসময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদান করার গুণাবলি রাখেন। কিন্তু পুরুষশাসিত শিল্পে নারী হয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করা বা কাজ করা কখনো কখনো বেশ কঠিন একটি বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সবকিছু বিবেচনা করে নারী পুরুষের সঙ্গে সমানগতিতে অথবা কখনো কখনো বেশি কাজ করেও পেছনের সারিতে পড়ে থাকার দিন শেষ হয়েছে। 

আনন্দের বিষয় হলো, আমাদের সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্য ধীরে ধীরে ভাঙছে। আমাদের দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারীদের অগ্রগতিকে খামচে ধরে আছে যৌন হয়রানি, যৌতুক প্রথা, বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক ব্যাধি। আছে নারীদের সমান কর্মঘণ্টায়ও পুরুষের তুলনায় প্রায় অর্ধেক মজুরির সমস্যা। অথচ নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্যের অবসান ঘটলে দেশ এবং পৃথিবী অনেক দূর এগিয়ে যাবে। নারীর অবদান ও অর্জনের স্বীকৃতি এবং মূল্যায়ন সমগ্র মানবজাতির শক্তি ও সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেবে কয়েকগুণ বেশি। নারীর মর্যাদাপূর্ণ ও ভয়হীন জীবনযাপন নারীর অধিকার শুধু নয়, নিশ্চিত করতে পারে সমগ্র বিশে^র মানবাধিকারও।

কখনো কখনো নারীর প্রতি অনাকাক্সিক্ষত বৈষম্যের কারণেই কর্মক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে পড়ে। বৈষম্যহীনতার সঙ্গে সঙ্গে দরকার সুস্থ কর্মপরিবেশ। এদিক থেকে আমাদের স্বপ্নের দেশ অনেক দূর এগিয়ে আছে। 

সব বিবেচনায় এখন বাংলাদেশের অর্থনীতে নারীর অবদান প্রকৃতই দৃষ্টিগ্রাহ্য। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মূল রফতানিজাত দ্রব্য পোশাক শিল্পের আশিভাগ কর্মী নারী। তা ছাড়া কৃষি, শিক্ষা ও প্রশাসনে নারীর ভূমিকা আগের চেয়েও অনেক বেশি অগ্রগামী। 

তা ছাড়া বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত শ্রমশক্তির জরিপে দেখা যায়, একজন নারী প্রতিদিন প্রায় ১৬ থেকে ২০ ঘণ্টা কাজ করে। আর কর্মজীবী নারীরা তাদের চাকরির জন্য সপ্তাহে ৪৪ ঘণ্টা এবং গৃহস্থালি কাজে ৪০ ঘণ্টা ব্যয় করে থাকে, যা একজন পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি।

সমাজের যে অংশটি সমাজ ও দেশের জন্য এতকিছু করে যাচ্ছে তাদের পেশাগত উন্নতি দরকার, আর এ জন্য দরকার পারিবারিক সহযোগিতা, যার মাধ্যমে নারী তার মেধা, মনন ও যোগ্যতার সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের মূলধারাতে অধিক একীভূত হতে পারে। কারণ এ কথা স্বীকৃত যে, পরিবারের সুখ ও শান্তির ওপর নির্ভর করে পেশাগত উন্নতি। তাই সব ক্ষেত্রে পরিবার থেকে সানন্দে সহযোগিতা দিতে হবে যা তার পেশাগত উন্নতিতে সহায়তা করতে পারে, এটিই হোক আজকের মূলমন্ত্র।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close