দেশের দরিদ্র এবং প্রায় অশিক্ষিত পরিবার থেকে নারী শ্রমিকেরা বিদেশে কাজের জন্য যাচ্ছেন। আর লাশ হয়ে ফেরত আসছে। যাদের লাশ দেশে এসেছে তাদের ৭৯ শতাংশই গৃহকর্মী হিসেবে বিদেশে কাজ করতে গিয়েছিলেন। আর লাশ দেশে আসার পর মৃত শ্রমিকের পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকলেও দেশে পুনরায় ময়নাতদন্তও করা হচ্ছে না। এ ছাড়াও শ্রমিকরা মারা যাওয়ার পর লাশের সঙ্গে পাঠানো মৃত্যু সনদে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ লিখে পাঠাচ্ছে সংশ্লিষ্ট দেশ। এটি খুবই আশ্চর্যের বিষয়। এর দায় রাষ্ট্রসহ সবাইকে নিতে হবে।
মঙ্গলবার জাতীয় সংসদ ভবনের পার্লামেন্ট মেম্বারস ক্লাবে অভিবাসী নারী শ্রমিকদের মৃত্যু নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে আলোচকরা এসব কথা বলেন। ২০১৭ সাল থেকে দেশে আসা ৫৫৮ নারী শ্রমিকের মৃত্যুর কারণ ও করণীয় বিষয়ে ‘ডেথ অব উইমেন মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স ইন ডেস্টিনেশন কান্ট্রিজ’ শীর্ষক এ গবেষণা করেছে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু)।
গবেষণার তথ্য বলছে, মৃত্যু সনদে উল্লেখ করা মৃত্যুর কারণ অনুযায়ী ৬৯ শতাংশ শ্রমিকের স্বাভাবিক (বিভিন্ন রোগসহ) এবং ৩১ শতাংশ নারী শ্রমিকের অস্বাভাবিক (দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা) মৃত্যু হয়েছে। অনুষ্ঠানে গবেষণার সারাংশ তুলে ধরেন রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন তাসনিম সিদ্দিকী। গবেষণার বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ নজরুল ইসলাম। তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ অর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে পাওয়া নারী অভিবাসীর মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গবেষণায় মৃত নারী শ্রমিকের ১০০টি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে তাদের মতামত নেওয়া হয়েছে। আর গবেষণাটি করা হয়েছে নারী শ্রমিকের মৃত্যু নিয়ে তথ্য জানার পাশাপাশি অভিবাসন খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য। এতে কারো ওপর দায় চাপানো হয়নি, তবে সংশ্লিষ্টদের করণীয় বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।
গবেষণায় ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দেশে আসা ৬৯১ নারী অভিবাসীর মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে শ্রমিক হিসেবে বিভিন্ন দেশে যাওয়া নারী শ্রমিক ছিলেন ৫৫৮ জন। গবেষণায় ১০০টি পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, যাদের লাশ দেশে এসেছে তাদের ৭৯ শতাংশই গৃহকর্মী হিসেবে বিদেশে কাজ করতে গিয়েছিলেন। ১০ শতাংশের বিদেশে যাওয়ার আগেই কোনো না কোনো ক্রনিক অসুখ ছিল। পরিবারের সদস্যরা স্বজনের মৃত্যুর তথ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জানতে পেরেছেন ওই দেশে কর্মরত অন্য বাংলাদেশি শ্রমিক বা অন্যদের কাছ থেকে। দূতাবাস থেকে খবরটি পেয়েছেন সবার শেষে। লাশ পাওয়া পরিবারগুলোর ৪৮ শতাংশই মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
আলোচনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য মো. সেলিম রেজা এর আগে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে সাবেক সচিব এবং মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি অভিবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর বিষয়ে দ্রুত তথ্য পাওয়ার জন্য বিশেষ অ্যাপ তৈরির সুপারিশ করেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, অভিবাসী নারী শ্রমিকদের লাশ দেশে ফেরার পর ময়নাতদন্ত করলে তা শ্রম বাজারে প্রভাব ফেলবে- এমন ভয়ের কোনো কারণ নেই। নারী শ্রমিক পাঠানোর চুক্তিতেই কোনো শ্রমিক মারা গেলে তার দায় সংশ্লিষ্ট দেশের মালিকের- তা উল্লেখ করতে হবে।
রামরুর গবেষণার তথ্য উল্লেখ করে সেলিম রেজা বলেন, লাশ হয়ে ফেরত আসা নারী শ্রমিকদের ৭৯ শতাংশই গৃহকর্মী হিসেবে কাজে গিয়েছিলেন। এ পেশায় নারীদের না পাঠিয়ে অন্য পেশার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশ আর কত দিন ‘কাজের বুয়া’ বিদেশে পাঠাবে তাও ভাবার সময় এসেছে। যাওয়ার আগে নারী শ্রমিকদের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে তাতে ফিলিপাইনের মতো আত্মরক্ষার কৌশল শেখানোরও সময় এসেছে।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক যে মৃত্যুই হোক সংশ্লিষ্ট দেশ প্রতিটি মৃত্যুর ময়নাতদন্ত করবে সে ধরনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। গত কয়েক বছর ধরে শ্রমিকের মৃত্যু সনদে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ লিখে পাঠানো হচ্ছে সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে, এটা দুঃখজনক। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিত করে শ্রমিকের মৃত্যু সনদের ফরম্যাট তৈরি করতে হবে। শ্রমিকের সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা মোবাইল ফোনে যাতে নিয়মিত যোগাযোগ করতে পারেন তাও নিশ্চিত করতে হবে।
অনুষ্ঠানে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম বলেন, রামরুর গবেষণা নির্মোহ এবং এটিকে পক্ষপাতদুষ্ট বা উদ্দেশ্যমূলক বলে মনে হচ্ছে না। তিনি বলেন, অনেক সময় মনে করা হচ্ছে মৃত্যুর কারণকে চ্যালেঞ্জ করা হলে তা শ্রম বাজারে প্রভাব ফেলতে পারে। তবে সত্যকে তো আর বেশি দিন চেপে রাখা সম্ভব না। নিজেদের গবেষণার প্রয়োজনে হলেও পরিবারের সম্মতি নিয়ে মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ থাকা ৫ থেকে ১০ শতাংশ লাশের ময়নাতদন্ত করা প্রয়োজন। মৃত শ্রমিকের পরিবারকে কল্যাণ বোর্ড থেকে যে তিন লাখ টাকা দেওয়া হচ্ছে, সেই প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করার সুপারিশ করেন তিনি।