ই-পেপার বুধবার ৬ ডিসেম্বর ২০২৩
বুধবার ৬ ডিসেম্বর ২০২৩

খোকার স্বপ্ন
জহিরুল ইসলাম
প্রকাশ: শনিবার, ১৮ মার্চ, ২০২৩, ৫:১০ এএম  (ভিজিট : ২২৮)
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয় এক শিশু। নাম তার খোকা। এই শিশুর আগমনে আজানের ধ্বনি, মধুমতী নদীর ঢেউ, পাখিদের কলতানে পুরো গ্রাম যেন আনন্দে মেতে ওঠে। সারা গ্রামে মিষ্টি বিলানো হয়। গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করা হয় কাপড়। মিলাদ পড়ানো থেকে শুরু করে নানা আয়োজনে উৎসবের এলাকায় পরিণত হয় গ্রামটি। সেই খোকা একটু বড় হয়ে উঠতেই বাড়ির মুরব্বি, শিক্ষক, কৃষক, মাঝি সবাই একবাক্যে স্বীকার করে নেন, এই শিশুটি অন্য সব শিশুর মতো নয়। সে সবার থেকে আলাদা। 

ছোটবেলা থেকেই খোকা মনের মধ্যে একটি স্বপ্ন নিয়ে বড় হতে থাকে। সে হলো মানুষের মুক্তি। জোতদার-মহাজনের পীড়ন থেকে গরিবের মুক্তি, শক্তিমানদের নির্যাতন থেকে দুর্বলদের মুক্তি, মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক মুক্তি, সর্বোপরি জাতীয় মুক্তি। তাই তো তার মধ্যে একদিকে দেখা যায় মানবিকতা ও মহানুভবতার অনন্য গুণ, অন্যদিকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর আপসহীনতার ছবিও তার মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ছোটবেলা থেকে খোকার মনটা ছিল অনেক বড় এবং পরোপকারী। কারও দুঃখ-কষ্ট দেখলে এগিয়ে যেত। কারও গায়ে জামা না থাকলে নিজের গায়ের জামা খুলে দিত। কারও ছাতা না থাকলে নিজের ছাতা তাকে দিয়ে নিজে ঘরে ফিরত বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বা রোদে পুড়তে পুড়তে। স্কুলে নিজের টিফিন খেত অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে।

একবার এলাকায় বেশ বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলো। ফসলের অনেক ক্ষতি হলো। ঘরে ঘরে খাবারের জন্য হাহাকার পড়ে গেল। ছোট্ট খোকার মনে মানুষের জন্য অনেক কষ্ট। দাদা-দাদিকে বলে নিজেদের গোলাঘর থেকে ধান-চাল বিলানো শুরু করল। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল সংগ্রহ করে যাদের ঘরে খাবার নেই তাদের কাছে পৌঁছে দিতে লাগল। মানুষকে ক্ষুধামুক্ত করার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ল খোকা।
একবার খোকার বাবা কলকাতা থেকে সুন্দর একটা চাদর কিনে আনলেন ছেলের জন্য। খোকা সেটা পরে বাইরে বের হলো। ফেরার পথে দেখে জীর্ণশীর্ণ বয়স্ক একজন মানুষ গাছের নিচে বসে প্রচণ্ড শীতে কাঁপছেন। খোকা নিজের নতুন চাদরটা তার গায়ে পরিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে এলো শীতে কাঁপতে কাঁপতে। এমনই ছিল খোকার মানবতাবোধ।

খোকার গৃহশিক্ষক আবদুল হামিদ মুসলিম সেবা সমিতি নামে একটি সংগঠন চালাতেন। প্রত্যেক রোববার খোকাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন তিনি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুষ্টিচাল উঠিয়ে আনতেন। সেই চাল বিক্রি করে গরিব ছেলেদের বইখাতা, পরীক্ষার ফি ও অন্যান্য খরচ চালানো হতো। দূর থেকে পড়তে আসা ছাত্রদের তারা জায়গিরও ঠিক করে দিতেন। হঠাৎ যক্ষ্মা রোগে মারা গেলেন সেই শিক্ষক। এরপর খোকার ওপর ভার পড়ল সেই সেবা সমিতি পরিচালনার। বাড়ি বাড়ি ঘুরে সংগ্রহ করা চাল বিক্রি করে সেই টাকা একজন শিক্ষকের কাছে জমা রাখা হতো। তারপর প্রয়োজনমতো খরচ করা হতো। বলা যায়, সেই ছোটবেলা থেকেই খোকা জড়িয়ে যায় মানবমুক্তির সংগ্রামে।

একসময় গোপালগঞ্জে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বেশ রেষারেষি চলছিল। মাঝেমধ্যে দুয়েকজন মুসলমানের ওপর অত্যাচার হতো। আবদুল মালেক নামে খোকার এক সহপাঠী ছিল। একদিন খোকা ফুটবল খেলে বাড়িতে এসেছে। এমন সময় শুনতে পেল, মালেককে হিন্দু মহাসভার সভাপতি সুরেন ব্যানার্জির বাড়িতে ধরে নিয়ে মারপিট করা হচ্ছে। দেরি না করে কয়েকজন ছাত্রকে ডেকে নিয়ে খোকা সেই বাড়িতে গিয়ে প্রথমে মালেককে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করল। কিন্তু তারা তাকে ছাড়ল তো না-ই, বরং রমাপদ নামে একজন খোকাকে গালি দিয়ে বসল। খোকা প্রতিবাদ করল এবং তার দলের অন্য ছেলেদের খবর দিল। খবর পেয়ে সিরাজুল হক নামে খোকার এক মামা হোস্টেল থেকে দলবল নিয়ে ছুটে এলো। কিন্তু এর মধ্যেই দুই পক্ষে ভীষণ মারামারি হলো। রমাপদ একটা লাঠি দিয়ে খোকাকে মারতে চাইলে খোকাও লাঠি নিয়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার লাঠির আঘাতে মাথা ফেটে গেল রমাপদের। এক পর্যায়ে দরজা ভেঙে মালেককে বের করে নিয়ে এলো খোকার দল। এ ঘটনায় খোকাসহ অনেকের নামে মামলা হলো। জেলও খাটল খোকা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে কখনো পিছপা হতো না নির্ভীক খোকা। 

১৯৪৩ সালের কথা। ভারত, পাকিস্তান আর বাংলাদেশ মিলে তখন এক দেশ। ইংরেজরা শাসন করত সে দেশ। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ চলছিল তখন। বেশিরভাগ ধান-চাল সৈন্যদের জন্য নিয়ে গেছে ইংরেজরা। বাকি যা ছিল ব্যবসায়ীরা গুদামজাত করেছে। ফলে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা ১০ টাকা মণের চাল ৪০-৫০ টাকায় বিক্রি করছে। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে দেশে। গ্রাম থেকে লাখ লাখ লোক শহরের দিকে ছুটছে। খাবার নেই, কাপড় নেই। এমন দিন নেই রাস্তায় লোক মরে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। মা মরে পড়ে আছে, ছোট বাচ্চা সেই মরা মায়ের দুধ চাটছে। কুকুর ও মানুষ একসঙ্গে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। ছেলেমেয়েদের রাস্তায় ফেলে দিয়ে মা কোথায় যেন পালিয়ে গেছেন। পেটের দায়ে নিজের ছেলেমেয়েকে বিক্রি করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কেউ কিনতে রাজি হচ্ছে না। বাড়ির দুয়ারে এসে চিৎকার করছে, মা বাঁচাও, কিছু খেতে দাও, মরে গেলাম, আর পারি না, একটু ফেন দাও। এ কথা বলতে বলতে ওই বাড়ির দুয়ারের কাছেই পড়ে মরে যাচ্ছে। খোকা তখন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র। থাকে বেকার হোস্টেলে। দেশের এই দুঃসময়ে লেখাপড়া বাদ দিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল অসহায় মানুষের সেবায়। অনেক লঙ্গরখানা খুলল। দিনভর এসব করে রাতে কোনোদিন বেকার হোস্টেলে ফিরে, কোনোদিন লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে থাকত খোকা। এভাবেই অসহায় মানুষের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়ে খোকা।

এই খোকা বড় হয়ে সবার প্রিয় মুজিব ভাই হয়ে উঠলেন। পুরো নাম শেখ মুজিবুর রহমান। নিজে ছোটবেলা থেকে মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখতে দেখতে একসময় বাঙালি জাতিকেও দেখানো শুরু করলেন সে স্বপ্ন। দীর্ঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি অর্জন করল সেই মুক্তি। স্বাধীন হলো বাংলাদেশ। পূরণ হলো দীর্ঘদিন ধরে খোকার মনের লালিত স্বপ্ন।





https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড
এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫। ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close
https://www.shomoyeralo.com/ad/1698384544SA-Live-Update.jpg