আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে যে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে, তা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ। জাতিসংঘের দৃঢ় বিশ^াস, ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধের জন্য রুশ নেতাকে অভিযুক্ত করার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। তবে এ ধরনের মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে বাস্তব ও যৌক্তিক জটিলতার শেষ নেই। পুতিনকে আসলেই বিচারের মুখোমুখি করা যাবে কি না, কী কী সংকট রয়েছে, সেই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে জারি করা আইসিসির পরোয়ানা ইউক্রেন যুদ্ধেই বা কতটুকু প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে বিশ্লেষণাত্বক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি ও এএফপি।
পুতিন এখন নিজ দেশে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী, তাকে আইসিসির কাছে ক্রেমলিনের হস্তান্তরের কোনো সম্ভাবনা নেই। যত দিন তিনি রাশিয়ায় থাকবেন, তত দিন গ্রেফতার হওয়ার ঝুঁকি নেই বললেই চলে। রাশিয়ার বাইরে গেলে পুতিন আটক হতে পারেন। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় তার চলাফেরা ইতিমধ্যে সীমিত হয়ে গেছে। তাই যে দেশগুলো তাকে বিচারের আওতায় আনতে চায়, সেখানে পুতিনকে পাওয়ার সম্ভাবনা কম।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে হামলার শুরুর পর প্রেসিডেন্ট পুতিন মাত্র ৮টি দেশে সফর করেছেন। এর মধ্যে ৭টি দেশ রাশিয়ার পার্শ্ববর্তী। অর্থাৎ ১৯৯১ সালের শেষের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার আগে তারা রাশিয়ার সঙ্গেই ছিল। এই দেশগুলোর বাইরে আরেকটি দেশে তিনি সফর করেছেন, সেটি হলো ইরান। গত বছরের জুলাইয়ে দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলী খামেনির সঙ্গে দেখা করেন পুতিন। যেহেতু ইউক্রেন যুদ্ধে ইরান ড্রোন ও অন্যান্য সামরিক রসদ দিয়ে রাশিয়াকে সাহায্য করছে, তাই পুতিন ইরানে আবার গেলেও তার বিপদে পড়ার সম্ভাবনা নেই।
আসলেই কি বিচারের মুখোমুখি হবেন : এই ক্ষেত্রে অন্তত দুটি বড় প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। প্রথমত, রাশিয়া আইসিসির এখতিয়ার বা কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি দেয় না। ২০০২ সালে ‘রোম সংবিধি’ অনুযায়ী আইসিসি গঠিত হয়েছিল। ফলে এর আদেশ কেবল সেসব দেশের জন্যই খাটে, যারা ওই চুক্তিতে সই করেছিল। আইসিসির আইন অনুযায়ী চুক্তিতে সই করা দেশগুলোর কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধের অভিযোগ উঠলে সেই দেশ নিজস্ব ফৌজদারি কর্তৃত্ব প্রয়োগ করবে। আর সেই দেশগুলো যদি তদন্ত ও বিচার করতে না পারে, তখনই কেবল আইসিসি সেখানে হস্তক্ষেপ করবে। সব মিলিয়ে ১২৩টি দেশ আইসিসির চুক্তিতে সই করেছে, রাশিয়াসহ কিছু উল্লেখযোগ্য-সংখ্যক দেশ এতে নেই। আইসিসি গঠনের চুক্তিতে রাশিয়া সই না করায় সংস্থাটির পরোয়ানায় রাশিয়া থেকে কাউকে প্রত্যর্পণের বাধ্যবাধকতাও দেশটির নেই। সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, ‘আমাদের দেশের জন্য আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের ওই আদেশ অর্থহীন, এমনকি আইনি দৃষ্টিকোণ থেকেও ওই আদেশ কোনো অর্থ বহন করে না। রাশিয়া রোম সংবিধিতে সই করা দেশ নয়, আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতেরও অংশীদার নয়। ফলে ওই আদালতের আদেশ মানার কোনো দায়ও আমাদের নেই।’
আবার এই পরোয়ানাকে স্বাগত জানানো ইউক্রেনসহ কয়েকটি দেশ চুক্তিতে সই করেছে, তবে অনুসমর্থন দেয়নি এখনও। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, পুতিনের বিপক্ষে আইনি অবস্থান নড়বড়ে। দ্বিতীয়ত, বিবাদী ছাড়া কাঠগড়ায় বিচার পরিচালনার বিষয়টি সবার অজানা না হলেও, এটি এখানে খাটছে না। আইসিসি কারও অনুপস্থিতে বিচার করে না, তাই সেই পথটিও বন্ধ।
আইসিসির প্রেসিডেন্ট পিওতর হফমানস্কি বলেন, ‘রোম চুক্তি অনুমোদন করেনি রাশিয়ার এমন ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। বিশে^র দুই তৃতীয়াংশ দেশ রোম সংবিধির অংশ। এই চুক্তি অনুমোদনকারী এমনকি এই আদালতের বিচারকাজের স্বীকৃতি দেওয়া যেকোনো সদস্য দেশের অভ্যন্তরে হওয়া অপরাধের বিচার করার এখতিয়ার আছে আদালতের।’ ইউক্রেনও ২০১৪ এবং ২০১৫ তে দুবার আইসিসির কার্যক্রমকে স্বীকৃতি দেয় উল্লেখ করে হফমানস্কি বলেন ‘অপরাধী যে দেশই হোক না কেন নভেম্বর ২০১৩’-এর পর থেকে ইউক্রেনের ভূখণ্ডে যে কারও ওপর সংঘটিত অপরাধের বিচার করবে আদালত।’
তবে আদালতের কাঠগড়ায় পুতিনকে নেওয়া আপাতত অসম্ভবই বটে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বাধা যেখানে : ‘পুতিনকে আদালতে নিতে হলে রাশিয়ায় ক্ষমতার পরিবর্তন হতে হবে’ মনে করেন নেদারল্যান্ডসের লেইডেন বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সিসিলি রোজ। আদালতের নিজস্ব কোনো পুলিশ বাহিনী নেই যারা এই পরোয়ানা অনুসারে পুতিনকে গ্রেফতার করবে। ইউক্রেন আদালতের কার্যক্রমের স্বীকৃতি দিলেও রোম সংবিধি চুক্তিতে সই করেনি।
রাশিয়া তার কোনো নাগরিককেই এখন পর্যন্ত কোনো দেশে বা কারও হাতে তুলে দেয়নি বা হস্তান্তর করেনি। পুতিনকেও করবে না রাশিয়া বলাই বাহুল্য। অভিযুক্তের অনুপস্থিতিতে বিচারকাজ হয় না এই ট্রাইব্যুনালে। তবে ব্যতিক্রম জোসেফ কোনি। উগান্ডার বিদ্রোহী নেতা ও দেশটির সন্ত্রাসবাদী সংগঠন লর্ড রেজিসট্যান্স আর্মি-এলআরএর প্রতিষ্ঠাতা কোনির অনুপস্থিতেই বিচার চালায় আইসিসি।
ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর নৃশংসতা চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে ক্রেমলিন। পুতিনের মুখপাত্র আইসিসির সিদ্ধান্তকে ‘অদ্ভুত ও অগ্রহণযোগ্য’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বিবিসির প্রতিবেদনে উপসংহার টানা হয়েছে, এ ধরনের অবাধ্যতার পরিস্থিতিতে আইসিসির পদক্ষেপ ইউক্রেনে যুদ্ধের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না। সেই সঙ্গে পুতিনের ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ নির্দয়ভাবে মানুষকে পিষে যেতে যাবে।