যথাসময়ে কাজ সম্পন্ন করতে না পারায় কার্যাদেশ বাতিল করা হলেও জরিমানার পরিবর্তে আলোচিত ঠিকাদার জিকে শামীমকে অবৈধভাবে ১০ কোটি টাকা বিল প্রদান করেছে গণপূর্ত অধিদফতর। এ ছাড়া কার্যাদেশ বাতিলের পর জিকে শামীমের পারফরম্যান্স সিকিউরিটির অর্থ বাজেয়াপ্ত না করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১২ কোটি টাকা। সম্প্রতি অডিট বিভাগের এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এই অনিয়ম ধরা পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গণপূর্ত অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী, শেরেবাংলা নগর-১-এর অধীনে বাস্তবায়নাধীন আগারগাঁও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পের কাজে জালিয়াতির মাধ্যমে সাড়ে ১০ কোটি টাকা অতিরিক্ত বিল প্রদান করা হয়েছিল জেলহাজতে থাকা জিকে শামীমের প্রতিষ্ঠানকে। ম্যাজিস্ট্রেটের সরেজমিন পরিদর্শনের মাধ্যমে এই অতিরিক্ত বিল প্রদানের প্রমাণ পাওয়া যায়। অথচ এই অতিরিক্ত টাকা সমন্বয় করা হয়েছে সোহরাওয়ার্দী হাসাপাতালে জিকে শামীমের ১২ কোটি টাকার কাজ বেশি করা ছিল দেখিয়ে।
সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, দুই প্রকল্পের কাজ দুটি ভিন্ন চুক্তিতে এবং ভিন্ন অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল। জিকে শামীমকে দুটি প্রকল্পেই ডিফল্ট দেখানো হয়েছে এবং চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করায় নিয়ম অনুযায়ী দুটি প্রকল্পেই তার পারফরম্যান্স গ্যারান্টি বাতিল করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে টাকা জমা হওয়ার কথা। কিন্তু তা না করে উল্টো তাকে ১০ কোটি টাকার বিল পরিশোধ দেখিয়ে তা অন্য প্রকল্পে অতিরিক্ত প্রদান করা ১০ কোটি টাকা সমন্বয় করা হয়েছে। এ অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী এবং জিকে শামীমের ঘনিষ্ঠ একটি চক্র জড়িত বলে জানা গেছে। কারণ জরিমানা বা পারফরম্যান্স গ্যারান্টি বাতিল করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে টাকা জমা না করে বিল সমন্বয় করেছেন বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী মোয়াজ্জেম হোসেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, জিকে শামীমের একটি প্রকল্পের কাজে অতিরিক্ত প্রদান করা বিল যে প্রকল্পের বিল থেকে সমন্বয় করা হয়েছে সেটি জিকে শামীমের প্রতিষ্ঠান অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জয়েন্টভেঞ্চারে কাজ পেয়েছে। তাই দুটি কাজের অ্যাকাউন্ট আলাদা হওয়ায় বিল সমন্বয় করার কোনো সুযোগ নেই। নিয়ম অনুযায়ী দুটি প্রকল্প যথাসময়ে শেষ করতে না পারায় কাজের জামানতের টাকা বাতিল হয়ে সরকারি কোষাগারে জমা হওয়ার কথা। অধিদফতরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার নির্দেশে জামানত বাজেয়াপ্ত না করে তা বিলের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে, যা বড় ধরনের আর্থিক অনিয়ম বলে একাধিক প্রকৌশলী জানান। বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী মোয়াজ্জেম হোসেন বিল সমন্বয় করে বিষয়টি প্রধান প্রকৌশলীকে চিঠি দিয়ে অবগত করেছেন। কিন্তু অবৈধভাবে অতিরিক্ত বিল প্রদানের জন্য দায়ী নির্বাহী প্রকৌশলী এবং অবৈধভাবে বিল সম্বয়ের জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। বরং বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আগারগাঁও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পের কাজে সাড়ে ১০ কোটি টাকা অতিরিক্ত বিল প্রদান করার সঙ্গে জড়িত নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফজলুল হকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলমান রয়েছে। অভিযুক্ত নির্বাহী প্রকৌশলী পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
তিনি সময়ের আলোকে বলেন, এ বিষয়টি ইতিমধ্যে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। নিষ্পত্তি হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়নি।
এ বিষয়ে গণপূর্ত বিভাগ, শেরেবাংলা নগর-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, অতিরিক্ত বিল প্রদান করা হয়েছিল তার আগের নির্বাহী প্রকৌশলীর সময়ে। তিনি কোনো বিল প্রদান করেননি। নিরাপত্তা জামানত কেটে তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়ে বিল সমন্বয় করেছেন। এ ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়নি। কারণ পাওনা আদায় আইন মেনেই এটা করা হয়েছে।
অন্যদিকে অডিট বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাহী প্রকৌশলী, গণপূর্ত বিভাগ, শেরেবাংলা নগর-১-এর আওতায় শহিদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের বিভিন্ন ক্রয়কার্যের চুক্তিপত্র ও বিল ভাউচার যাচাই করে দেখা যায়, জিকে শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিকেবি অ্যান্ড কোম্পানির অনুক‚লে মোট মূল্যায়িত মূল্য ১২০ কোটি ৫৮ লাখ ৯৭ হাজার টাকার কার্য প্রস্তাব ১০ শতাংশ পারফরম্যান্স সিকিউরিটি আরোপের শর্তে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছিল। সে পরিপ্রেক্ষিতে জারিকৃত এনওএর নির্দেশনা মোতাবেক ঠিকাদারের নিকট থেকে পারফরম্যান্স সিকিউরিটি বাবদ ১২ কোটি ৫ লাখ টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি গ্রহণ করা হয়। চুক্তি মোতাবেক নির্ধারিত ১২ মাস সময়ের মধ্যে ঠিকাদার কাজ সম্পাদন করতে ব্যর্থ হওয়ায় কর্তৃপক্ষ স্মারক নং- বি-১/গ্যারান্টি/১৪৫২ তারিখ ১৩-০৬-২০১৯-এর মাধ্যমে ব্যাংক গ্যারান্টির মেয়াদ বৃদ্ধির নির্দেশনা প্রদান করলেও ব্যাংক গ্যারান্টির মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়নি। ইতিমধ্যে ঠিকাদারের কার্যাদেশ বাতিল করা হলেও জিসিসি ৭৪.৩ অনুযায়ী ঠিকাদারের কাছ থেকে পারফরম্যান্স সিকিউরিটি বাবদ অর্থ বাজেয়াপ্ত না করায় সরকারের ১২ কোটি ৫ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
এ বিষয়ে গণপূর্ত অধিদফতর অডিট বিভাগকে জানায়, কাজটি চলমান এবং পরবর্তী সময়ে অডিটকে অবহিত করা হবে। ওই অনিয়মের বিষয়ে ২০২১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সচিব বরাবর নিরীক্ষা প্রতিবেদন এবং ২০২১ সালের ২৩ মার্চ তাগিদপত্র ইস্যু করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো নিষ্পত্তিমূলক জবাব প্রদান করা হয়নি। তাই অনিয়মের দায়-দায়িত্ব নির্ধারণপূর্বক আপত্তিকৃত অর্থ আদায় করা আবশ্যক বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বছরের পর বছর গণপূর্তের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণকারী জিকে শামীম দরপত্র নিয়ন্ত্রণের অভিযোগে বর্তমানে জেলে থাকলেও তার অদৃশ্য ক্ষমতা এখনও বিদ্যমান। জিকে শামীমের অপরাধ কর্মের সহযোগীরা গণপূর্ত অধিদফতরের গুরুত্বপূর্ণ পদে এখনও বহাল। কেউ কেউ অপরাধ আড়াল করে পদোন্নতিও নিয়েছেন।
গণপূর্তের ঠিকাদার জিকে শামীম গ্রেফতার হওয়ার পর আগারগাঁও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পের কাজ তার প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। এ অবস্থায় পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর) অনুযায়ী জিকে শামীমের প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা কাজটি বাতিল করে কর্তৃপক্ষ। ওই সময় এ প্রকল্পে ঠিক কতটুকু কাজ সম্পন্ন হয়েছে তা নিশ্চিত হতে গিয়ে কর্তৃপক্ষ দেখতে পায়, কাজের মূল্যের চেয়ে প্রায় সাড়ে ১০ কোটি টাকা বেশি পরিশোধ করা হয় শামীমের প্রতিষ্ঠান জিকে বিল্ডার্সকে। মূলত ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের কাজ শুরু করে জিকে শামীমের মালিকানাধীন জিকে বিল্ডার্স। এ প্রকল্পে ১৬৭ কোটি ৭৩ লাখ ৬৯ হাজার ৬৩৩ টাকা ব্যয়ে ১৫ তলা ভবন নির্মাণের জন্য সময় ছিল ২৪ মাস। কিন্তু কাজের কিছু অংশ শেষ হওয়ার পরই তাকে গ্রেফতার করা হয়। তখন গণপূর্তের পক্ষ থেকে সরেজমিন পরিদর্শন করে কর্তৃপক্ষ জেনেছে ‘ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান শোর পাইলিংয়ের কাজ শেষ করে হাসপাতালের মূল ভবনের মাটি কাটার কাজ আংশিক শেষ করেছে। বেজমেন্টের ম্যাটের প্রায় ৩০ ভাগ ঢালাই শেষ করে সেখানে ২ ও ৩ নম্বর বেজমেন্টের ছাদ ঢালাই শেষ হয়েছে।’
জাতীয় নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল নির্মাণকাজ দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকায় ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে গণপূর্ত অধিদফতর। এরপর বিধি মতে, নির্মাণকাজের যৌথ পরিমাপের জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাজমুল হোসাইনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। একই বছরের ২২ মার্চ প্রকল্প পরিচালক, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ঠিকাদারের প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলীর উপস্থিতিতে কাজের যৌথ পরিমাপ করা হয়। সেই যৌথ পরিমাপে সম্পাদিত কাজের মূল্যমান দাঁড়িয়েছে ১৯ কোটি ৫০ লাখ ৯ হাজার ৯৪৫ টাকা। এর মধ্যে ২০১৯ সালের ১৮ মার্চ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে ৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা বিল দেওয়া হয়েছে। আবার ৩ মাসের মাথায় ৩০ জুন আরও ২০ কোটিসহ মোট ২৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে ঠিকাদারকে। সেই হিসাবে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটিকে ১০ কোটি ৪৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা বেশি দেওয়া হয়েছে।
গণপূর্ত অধিদফতরের শেরেবাংলা নগর পূর্ত বিভাগ-১-এর বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন ২০২১ সালের ২১ মার্চ ঢাকা গণপূর্ত মেট্রোপলিটন জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীকে এ বিষয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। তার চিঠিতে ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক কাজের মূল্যায়ন এবং অতিরিক্ত বিল প্রদানের প্রমাণের কথাও বলা হয়েছে।
অন্যদিকে নির্বাহী প্রকৌশলী, গণপূর্ত বিভাগ, শেরেবাংলা নগর-১ ঢাকা এবং নির্বাহী প্রকৌশলী, গণপূর্ত মহাখালী বিভাগ, শেরেবাংলা নগর, কার্যালয়ের ২০১৭-১৮ হতে ২০১৯-২০ অর্থবছরের হিসাব নিরীক্ষা করা হয়। উল্লিখিত কার্যালয়ের আওতায় শহিদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, জাতীয় ক্যানসার হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, চক্ষুবিজ্ঞান ও নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের সম্প্রসারণ কাজের ক্রয় কার্যক্রমের ওপর পরিচালিত কমপ্লায়েন্স অডিটে চুক্তিপত্র এবং চূড়ান্ত বিল যাচাই করা হয়। এতে দেখা যায় যে, বিভিন্ন চুক্তির বিপরীতে কাজ সমাপনান্তে ঠিকাদারদের চূড়ান্ত বিলের দাবি পরিশোধকালে পূর্ত কাজের বিভিন্ন আইটেমে বিওকিউতে উল্লিখিত পরিমাণ অপেক্ষা অতিরিক্ত হারে বিল পরিশোধ করায় সরকারের মোট ২ কোটি ১৭ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
পারফরম্যান্স সিকিউরিটির অর্থ বাজেয়াপ্ত না করে সে টাকা অতিরিক্ত প্রদান করা বিলের সঙ্গে সমন্বয় করার বিষয়ে জানতে চাইলে গণপূর্ত অধিদফতরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. খায়রুল ইসলাম সময়ের আলোকে বলেন, বিষয়টি সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলীরা ভালো বলতে পারবেন।
এ বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জিকে শামীমের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ : ক্যাসিনোবিরোধী ‘শুদ্ধি’ অভিযান চলাকালে ২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গুলশানে নিজ কার্যালয় থেকে এস এম গোলাম কিবরিয়া ওরফে জিকে শামীমকে গ্রেফতার করে র্যাব।
ওই সময় শামীমের কার্যালয়ে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা, ১৬৫ কোটি টাকার স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) কাগজপত্র, ৯ হাজার মার্কিন ডলার, ৭৫২ সিঙ্গাপুরি ডলার, একটি আগ্নেয়াস্ত্র এবং মদের বোতল উদ্ধার করা হয়।
গুলশান থানায় শামীমের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মোট ৩টি মামলা করা হয়।
গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর অস্ত্র আইনে দায়ের হওয়া মামলায় জিকে শামীম ও তার ৭ দেহরক্ষীর সবাইকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। ঢাকার স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-৪-এর বিচারক শেখ সামিদুল ইসলাম এ রায় ঘোষণা করেন।