
যমুনা নদীর প্রকল্প নিয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি, বরং এটি এখনও ‘স্টাডি’ পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন নৌ-প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। সময়ের আলোকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এ কথা জানান তিনি।
যমুনা নদীকে ঘিরে প্রকল্পের সমালোচনা করে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ১ হাজার ১১০ কোটি টাকা ব্যয় করে যমুনা নদীর দুই পাড় সরু করাসহ বেশকিছু কাজ হাতে নেওয়া হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ সম্ভাব্যতা যাচাই না করা, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব ৭১ কর্মকর্তা থাকার পরও পরামর্শক খাতে ২১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা, অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ, প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এমন অনেক বিষয় যুক্ত করা হচ্ছে প্রকল্পে। সেই সঙ্গে জৈববৈচিত্র্য ধ্বংসের বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করা হয়। এ প্রকল্প নিয়ে গণমাধ্যমে সমালোচনার বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে নৌ-প্রতিমন্ত্রী বলেন, সমালোচনা ভালো জিনিস। সমালোচনাকে আমরা খারাপভাবে নিই না। কিন্তু যেকোনো বিষয়ে একটা কিছু বললেই সমালোচনা করতে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত নয়। যমুনা নদী নিয়ে এখনও আমরা চিন্তা-ভাবনা করছি। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে এ নদী নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা বিস্তারিত একটা স্টাডি করে নিতে চাই। এখানেই মিলিয়ন ডলার খরচ হয়ে যাবে। দেখা যাবে, স্টাডি শেষে আমরা যা চাচ্ছি তা আসছে না, বরং এর থেকেও ভালো কিছু পেতে পারি। সেখানে যে সুপারিশ আসবে সেটাই করা হবে।
এ সময় সমালোচকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, অপরিকল্পিত কাজ শেখ হাসিনার সরকার করে না। অনেকেই তো অনেক কিছুর সমালোচনা অতীতে করেছেন। অনেকেই তো বলছেন, পায়রা বন্দর হবে না এখানে। কিন্তু পায়রা বন্দর তো হয়ে গেছে। আবার পায়রা বন্দরে তো রেগুলার জাহাজ আসছে। কাজেই সমালোচনা হোক। সমালোচনাগুলো হলে ভালো। যারা এ প্রকল্পে কাজ করছেন, তারা আরও নির্ভুলভাবে পদক্ষেপ নিতে পারবেন।
নৌ-পরিবহন খাতের উন্নয়ন প্রসঙ্গে খালিদ মাহমুদ বলেন, এ সেক্টরে মেরিটাইম ওয়াটার রুটে আমাদের ব্যাপক আধুনিকায়ন হয়ে গেছে। যেমন আমাদের এখন যে জাহাজগুলো আসছে বা যাত্রীবাহী জাহাজগুলো আসছে, এগুলো অনেক আধুনিক। অনেক নতুন নতুন প্রযুক্তি এখানে যুক্ত করা হচ্ছে। এ ছাড়াও কার্বন নিঃসরণ ৫ শতাংশের নিচে রাখার যে নির্দেশনা, সেটাও কিন্তু আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। এ ছাড়াও যাত্রীদের সেবার জন্য আমাদের যে ৩৭টি বন্দর বন্ধ ছিল তার আধুনিকায়নের জন্য বড় ধরনের প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি। আমাদের এ প্রকল্পে ঢাকা, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ, বরিশালের ৪টি বন্দরকে আধুনিকায়ন করেছি।
যাত্রীসেবা বাড়াতে আরও ১৫টি ল্যান্ডিং স্টেশন হবে বলেও জানান প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, নৌ পর্যটকরা বিভিন্ন স্থানে নামতে চান। অনেক ক্ষেত্রেই নামার কোনো স্থান না থাকায় তা আর হয়ে ওঠেন না। এ জন্য ল্যান্ডিং স্টেশনগুলা হচ্ছে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ১০ হাজার কিলোমিটার নদীপথ তৈরির নির্বাচনি ইশতেহার বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তেও রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, একদম চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত আমাদের যে নৌরুট আছে সেটাকে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে জাহাজ চলাচলের সহায়ক করছি। আমরা সাড়ে ৭ হাজার কিলোমিটার নৌপথ চালু করতে পেরেছি, যার ৫ হাজারের কাছাকাছি শুষ্ক মৌসুমে সচল থাকে।
তবে নৌ খাতের উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে স্কিল ডেভেলপমেন্টে। খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নৌ সেক্টরে যারা কাজ করছেন তাদের স্কিল ডেভেলপমেন্টের জন্য অনেকগুলো ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছি। পরীক্ষা দিয়ে তারা সার্টিফিকেটও নিতে পারছেন। নতুন আরও ইনস্টিটিউট তৈরি করছি। এর বাইরেও অভ্যন্তরীণ রুটে জাহাজের যে নকশা আমাদের রয়েছে তা আরও আধুনিকায়ন করার জন্য আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। ইতিমধ্যেই চাঁদপুরে এ ধরনের নকশা উপস্থাপন করা হয়েছে। এককথায় বললে, নদীমাতৃক এ বাংলাদেশে আমাদের অভ্যন্তরীণ যে নৌবন্দরগুলো আছে, সেগুলোতে সুযোগ-সুবিধা বাড়াচ্ছি আমরা।
নদী রক্ষা কার্যক্রম প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, এরই মধ্যে ডেল্টাপ্ল্যান ঘোষণা করা হয়েছে। নদীমাতৃক এ দেশে নদীর প্রবাহটা কীভাবে নিশ্চিত করতে হবে সে বিষয়ে কাজ করছি। নদী রক্ষার ক্ষেত্রে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘একজন মানুষের শিরার মধ্য দিয়ে যে রক্তপ্রবাহ যায়, সেটা যদি কখনো থেমে যায় তাহলে কিন্তু মানুষের প্রাণ থাকে না। আর নদী হচ্ছে বাংলাদেশের শিরায় রক্তপ্রবাহ। যখন বন্ধ হয়ে যাবে, বাংলাদেশেরও প্রাণ থাকবে না।’ কাজেই এটা হচ্ছে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কথা। এটা কিন্তু একটা বেজলাইন।
বাংলাদেশ ও ভারত পরস্পরের সঙ্গে আকাশ ও সড়কপথের পাশাপাশি নৌপথেও যোগাযোগ বাড়ছে বলে জানান খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, দুই দেশের মধ্যে অনেকগুলো নৌ প্রটোকল রয়েছে। কয়েক দিন আগে ভারতের প্রমোদতরী ‘এমভি গঙ্গা বিলাস’ প্রায় ৩ হাজার ২০০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার অতিক্রম করেছে। এখানে নৌ-বাণিজ্যও যুক্ত আছে।
তবে এসব কিছুই স্থিতিশীল সরকার থাকার কারণে সম্ভব হয়েছে বলে মন্তব্য করেন নৌ-প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, রেল, সড়ক, আকাশ সব পথেই আমাদের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক রয়েছে। এর কারণ দেশের স্থিতিশীল সরকার। বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি, ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেটাই বাস্তবায়ন করেছেন। আর সে কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। ’৭৫ পরবর্তী সময়ে খালেদা জিয়া ও অন্য যারা ক্ষমতায় এসেছিলেন তারা এটাকে অনুসরণ করেননি। তারা ভারতবিরোধী একটা স্লোগান দিয়ে সাম্প্রদায়িক সেন্টিমেট তৈরি করে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করেছেন। যার পরিণাম ভালো হয়নি। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সে সময় ভালো ছিল না। বাংলাদেশেরও কোনো উন্নয়ন হয়নি। বাংলাদেশে বরং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ তলিয়ে গেছে। আজকে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে প্রতিবেশীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়েছে এবং দুই দেশের মধ্যকার উষ্ণ সম্পর্ক অন্য এক উচ্চতায় পৌঁছেছে। এ কারণে আমাদের এতগুলো নৌ প্রটোকল হয়েছে ভারতের সঙ্গে। আমাদের নৌ-বাণিজ্য হয়েছে, আমরা ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছি। ভারত তাদের সেভেন সিস্টার্সে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করতে পারছে। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে সহায়তা করছে। মূলত এ এলাকার মানুষগুলো সহায়তাগুলো পাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী সবসময় মানুষের অধিকারকে সর্বোচ্চ মূল্য দেন। অন্যরা দেখছে, ‘আমার আর তোমার’। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মানবিক প্রধানমন্ত্রী। তিনি ভারতের ওই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান যেন বাড়ে, এটাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। সে কারণেই ভারতের সঙ্গে আমাদের দুর্দান্ত সম্পর্ক। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অবস্থান ছোট হয়নি, বরং ভ‚-রাজনৈতিক দিক থেকে অনেক ভালো অবস্থানে চলে আসতে সক্ষম হয়েছি আমরা।
ভারতের তিস্তা নদী নিয়ে কোনো সমঝোতা এখনও হয়নি। উল্টো তিস্তা নদীর পানি দুটি খাল খনন করে অন্যদিকে প্রবাহিত করার ব্যবস্থা নিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নৌ-প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমাদের যৌথ নদী কমিশন রয়েছে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তো নিয়মিতই তারা কথাবার্তা বলে। এ ধরনের অফিসিয়াল বিষয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এসেছে কি না আমরা জানা নেই। এটা হয়তো পত্র-পত্রিকায় আমরা দেখছি। যখন অফিসিয়ালি আমরা কথা বলব, তখন অবশ্যই এ বিষয়ে আলোচনা হবে। বাংলাদেশ সরকার তো নতজানু নীতিতে চলে না। আমরা তো ভারতের সঙ্গে শুধু তিস্তা সংযুক্ত নই। আরও অনেক বিষয় রয়েছে ভারতের সঙ্গে। বন্ধুত্ব বজায় রাখতে সব বিষয় দেখতে হবে।
সাক্ষাৎকারের শেষ পর্বে সমসাময়িক রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে কথা বলেন নৌ-প্রতিমন্ত্রী। এ সময় তিনি বেশ স্পষ্ট করেই বলেন, ‘বিএনপি আওয়ামী লীগের কোনো স্ট্রাগল নয়। বরং তারা নির্বাচন কমিশনের স্ট্রাগল।’ তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে কি না, এ দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের।
বিএনপি তার সিদ্ধান্তে অটুট থাকতে পারে না মন্তব্য করে খালিদ মাহমুদ বলেন, যদি বিএনপি নির্বাচন না করে, তাহলে প্রশ্ন, কেন করবে না? তারা ১৪ সালে বলেছিল, শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন করব না। ৫ বছর পর তো সে দাবি থেকে সরে গেছে। নির্বাচন তো করেছে। তারা তো ওই জায়গাটায় নেই। এখন তারা যদি স্ববিরোধী কোনো কাজ করে, তাহলে জনগণ তা মেনে নেবে না।
এ সময় তিনি বলেন, নির্বাচনে যে বিএনপির প্রয়োজন আছে, সেটা তারা (বিএনপি) মনে করে, জনগণ মনে করে না। বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে জনগণের কাছে যেতে হবে। দূতাবাসে বিদেশিদের কাছে গিয়ে, বিদেশে গিয়ে চিঠি লিখে ও দেশবিরোধী কথাবার্তা বলে বাংলাদেশে রাজনীতি করা কোনোভাবে সম্ভব নয়।
বিএনপি দিবাস্বপ্ন দেখছে মন্তব্য করে নৌ-প্রতিমন্ত্রী বলেন, এপিজে আবদুল কালাম বলেছিলেন, এমন স্বপ্ন দেখতে হবে যা ঘুমাতে দেয় না। এটাই প্রকৃত স্বপ্ন। ওরা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে। এ স্বপ্ন কোনোদিন বাস্তবায়ন হবে না।