‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা,আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই,আপনারা যেখানেই থাকুন,আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি খেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটি উৎখাত করা এবং চুড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে এভাবেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।তিনি স্বাধীনতার ঘোষণার সিন্ধান্ত আগে থেকেই নিয়ে রেখেছিলেন। শুধু চেয়েছিলেন প্রথম আক্রমনটা পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আসুক যাতে বিশ্বের কাছে আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারে।এজন্যই পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ শুরু করার পর দ্রুতই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘোষণার বার্তাটি প্রেরণ করেন।
স্বাধীনতার ঘোষণা তো এমন কোন বিষয় নয় যে,একজন মেজর ঘোষণা করলো আর সাত কোটি বাঙালি হ্যামিলনের বাঁশি ওয়ালার মত যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো।এ পরিস্থিতির জন্য একটি জাতির দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম থাকে, একটি প্রকৃয়া থাকে,প্রস্তুতি থাকে।এটা কোনো ব্যক্তির ঘোষণার বিষয় নয়।১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণ দিয়েছিলেন,প্রকৃতপক্ষে সেটাই ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা।তারপর থেকে বাঙালির কাছে আলাদা কোন ঘোষণার প্রয়োজন ছিলনা।সেদিন তিনি বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’তারপর থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হয়ে গিয়েছিল।১৯ মার্চ গাজীপুরের জয়দেবপুরে সশস্ত্র পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ বাঙালীরা রুখে দাঁড়িয়েছিল।চট্টগ্রামে অবস্থান করা বাঙালি সেনারা বিদ্রোহ শুরু করেছিল।
১৯৭১ সালের পুরো মার্চ জুড়ে পাকিস্তানি শাসক চক্র বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার নামে সময়ক্ষেপন করে।এর মধ্যে কৌশলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলায় সৈন্য সংখ্যা বাড়াতে থাকে।২৫ মার্চ মধ্যরাতে অপারেশন সার্চ লাইটের নামে শুরু হয় গণহত্যা।এবং পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের জন্য সেনাবাহিনীর একদল ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি ঘিরে ফেলে।এমন সময় গ্রেফতারের আশংকা মাথায় রেখেই ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করেন।
বঙ্গবন্ধু বাঙালিদের অধিকার আদায়ে ধারাবাহিক ভাবে দীর্ঘ চব্বিশ বছর সংগ্রাম করেছেন।এর মধ্যে প্রায় চৌদ্দ বছরেই কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে জীবন কাটিয়েছেন।পূর্ব বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনকে স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিনত করেছেন।সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্যদিয়ে শুধুমাত্র দলের নয়, বাঙালির একমাত্র অবিসংবাদিত নেতায় পরিনত হয়েছেন।স্বাধীনতার ঘোষণা যে কেউ ইচ্ছা করলেই দিতে পারেন না।তাঁর সেই বৈধতা থাকতে হয়। যিনি দীর্ঘদিন জাতির মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন,মানুষও বিশ্বাস করে তিনি তাদেরই নেতা,তাদের অতি আপনজন।যার আহবানে মানুষ মৃত্যু ভয়কে তুচ্ছ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে তিনিই জাতির নেতা হন।এমন নেতা তখন বাঙালির মধ্যে একজনই ছিলেন,তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বার্তা চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কাছে পৌঁছালে ২৬ মার্চ বিকেলে তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান সকল নেতাদের সম্মতিক্রমে বেতারে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও বেতারের কর্মকর্তারা সিন্ধান্ত নিলেন যদি কোনো সেনা কর্মকর্তাকে দিয়ে ঘোষণাটি পাঠ করানো যায় তাহলে বাঙালি সেনারা উদ্ভুদ্ধ হবে।সে মোতাবেক জিয়াউর রহমানকে নিয়ে আসা হয়।তিনি ২৭ তারিখ সন্ধ্যায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।তিনি ঘোষণায় বলেন, ‘আমি মেজর জিয়া,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে একটি সার্বভৌম ও আইনসিদ্ধ সরকার গঠন করেছি।
বিএনপি জিয়াকে ঘোষক তো দূরের কথা, প্রথম পাঠকও তো দাবি করতে পারে না ,কারণ ২৬ তারিখ সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান। তার পরের দিন সন্ধ্যায় জিয়াউর রহমান পাঠ করেন।এর মাঝে আরো অনেকেই বিছিন্ন ভাবে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছেন।তবে জিয়াউর বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছেন সেটা ইতিহাসে স্বীকৃত, অস্বীকার করার উপায় নেই।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষনার আলোকে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়। যার নাম দেয়া হয় মুজিবনগর সরকার।১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আম্রকাননে মুজিবনগর গঠন করা হয়।সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়।বঙ্গবন্ধুর নামে ও নেতৃত্বে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়।জিয়াউর রহমানও এই মুজিবনগর সরকারের অধীনেই মুক্তিযুদ্ধ করেছেন।তিনি মুক্তিযুদ্ধে বেশ কয়েকজন সেক্টর কমান্ডারের মধ্যে একজন ছিলেন।
জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বানানো,বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড় করানো মূর্খতা ছাড়া কিছুই নয়।বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় এমন দুঃসাহস কেউ-ই দেখাননি বা দেখাতে পারেননি।১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মম ভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর তাঁকে ইতিহাস থেকে মুছে যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল।জিয়াকে ঘোষক বানানো তারই অংশ।১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করে।তারই হাত ধরে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি বিএনপির প্লাটফর্মে ঐকবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পায়।নিজেদের কলঙ্কমোচনের দায় থেকেই জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বানানোর চেষ্টা শুরু হয়।
জিয়াউর রহমান জীবদ্দশায় কখনো নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেনি।বরং তিনি তার লেখা কিংবা বক্তব্যে সবসময়ই বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ উপ-সেনাপ্রধান থাকাকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ‘একটি জাতির জন্ম’ নামে প্রবন্ধে লেখেন,‘৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক গ্রিন সিগন্যাল বলে মনে হলো।আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চুড়ান্তরূপ দিলাম।তিনি আরো লিখেন,একাডেমিক ক্লাসগুলোতেও সবসময় বোঝানো হতো,আওয়ামী লীগ হচ্ছে ভারতের দালাল।পাকিস্তানের সংহতি বিনষ্ট করতেই আওয়ামী লীগ সচেষ্ট। এমনকি উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবেই ক্যাডেটদের শেখানো হতো,আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন ওদের রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শত্রু।’এছাড়া ১৯৭৬ সালে ২৭ মার্চ এক সাক্ষাৎকারে জিয়াউর রহমান বলেছিলেন,‘আজকে আমার সেই দিনটির কথা খুব মনে পরছে।১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ,যেদিন আমার নেতা মহান রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলাম।আমি দুই বারই জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলাম।’
১৯৮২ সালে হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় আসার পরও ইতিহাস বিকৃতি করা হয়নি।তখন তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রের তৃতীয় খন্ড প্রকাশ করা হয়।সেখানেও বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ মধ্য রাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।যা তৎকালীন ইপিআর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।পরে চট্টগ্রামের একটি স্থানীয় বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ আরো বেশ কযেকজন শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।’
কিন্তু ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় আসার পরই বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করতে ইতিহাস বিকৃতির নোংরা খেলা শুরু হয়।হঠাৎ করে জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক ঘোষণা করা হয়।২০০৪ সালে জোট সরকারের সময় মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রনালয় কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রের ১৫ তম খন্ডে পুনর্মুদ্রণে মেজর জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ ১৯৭১ তারিখে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়।যা নিয়ে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়।পরবর্তীতে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে হাইকোর্টে রীট হয়।হাইকোর্ট পুনর্মুদ্রণকৃত ‘মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা’ অংশটি বাতিল এবং এই খন্ডটি বাজেয়াপ্ত করতে সরকার নির্দেশ দেন।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা গণপরিষদ কর্তৃক স্বীকৃত ও অনুমোদিত। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা,১৯ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার কর্তৃক জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ।এজন্য বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে বিতর্ক সৃষ্টি করা সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল।যা রাষ্ট্রদ্রোহমূলক অপরাধ।
লেখক:
সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
ইমেইল:haldertapas@gmail.com.