নানা আলোচনা ও পদক্ষেপের পরেও অর্থ পাচার যেমন বন্ধ হয়নি, তেমনি বিদেশে পাচার হওয়া অর্থও ফেরত আনা যাচ্ছে না। অর্থ পাচার সংক্রান্ত আলোচনা উঠলেই সবার অভিযোগের তীর গিয়ে পড়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ওপর। অথচ মানি লন্ডারিং আইনে অর্থ পাচার সংক্রান্ত ২৭ ধরনের অপরাধের মধ্যে মাত্র একটি ‘ঘুষ ও দুর্নীতি’র মাধ্যমে অর্জিত অর্থ পাচারের তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দুদককে। যদিও বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৮০ শতাংশ অর্থ পাচার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে হয়ে থাকে। যেখানে বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ পাচার-সংক্রান্ত তদন্তের দায়িত্ব জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও পুলিশের অপরাধী তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ওপর ন্যস্ত। এ ক্ষেত্রে দুদকের সীমাবদ্ধতা দূর করাসহ অর্থ পাচার রোধ ও পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে মানি লন্ডারিং আইনের অধীনে আরও সাত ধরনের অপরাধকে দুদকের তফসিলভুক্ত করাসহ সরকারের কাছে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
সম্প্রতি প্রকাশিত দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন-২০২২-এ এসব সুপারিশ করা হয়েছে। অন্যদিকে নির্বাচনের সময় সব প্রার্থীর হলফনামায় দেওয়া সম্পদের হিসাব খতিয়ে দেখার কথা বলেছেন দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, দুদক এবার চোখ-কান খোলা রাখবে। মঙ্গলবার দুপুরে ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এমন মন্তব্য করেন। অনুষ্ঠানে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মো. মোজাম্মেল হক খান, কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক ও দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দুদক কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক খান বলেন, অনেক দুর্নীতিবাজ দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে, ব্যবসার আড়ালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে। এই বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের মাত্র একটি অপরাধের (ঘুষ ও দুর্নীতি) এখতিয়ার আছে। বাকি ২৬টি অপরাধের বিষয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এখতিয়ার। কিন্তু জনগণের মনে এখনও ভ্রান্ত ধারণা দুদক কি কাজ করে। কিন্তু আমাদের অংশে আমরা কাজ করি ও শতভাগ সাফল্য রয়েছে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রপতির কাছে দেওয়া প্রতিবেদনে অর্থ পাচার সংক্রান্ত দুদকের সীমাবদ্ধতা দূর করতে ৯টি পদক্ষেপ ও ৪টি সুপারিশ পেশ করা হয়েছে। সীমাবদ্ধতা নিরসনে দুদকের কার্যক্রম নিয়ে বলা হয়-প্রো-অ্যাক্টিভ অনুসন্ধানের লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স (এফএটিএফ) এবং এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিং (এপিজি) সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম পরিচালনা, মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠানো, বিদেশি এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয়, বিদেশে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনা সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য ইউনিট গঠন ও জনবল নিয়োগের লক্ষ্যে বিদ্যমান সাংগঠনিক কাঠামো পর্যালোচনা করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। সার্ভেইল্যান্স, কমিউনিকেশন ইন্টারসেপশন ও আন্ডারকাভার অপারেশন ইত্যাদি পরিচালনার জন্য ইউনিট গঠন ও জনবল নিয়োগের লক্ষ্যে কমিটি গঠন করা হয়েছে। মানি লন্ডারিং, ব্যাংক ও বীমা সংশ্লিষ্ট অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্ত, ফরেনসিক অ্যাকাউন্টিং, ডিজিটাল ফরেনসিক, সার্ভেইল্যান্স ও আন্ডারকাভার বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও স্টাডি ট্যুরের বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও আইসিটি অনুবিভাগ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে থাকে এমন দেশগুলোর দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার সঙ্গে তথ্য, ইন্টেলিজেন্স, সাক্ষ্য-প্রমাণ আদান-প্রদান, সম্পদ ফ্রিজ, ক্রোক, বাজেয়াপ্তকরণ ও পুনরুদ্ধার কার্যকর করার জন্য দ্বিপক্ষীয় আইনি সহযোগিতা চুক্তি (মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসট্যান্স ট্রিটি) করার বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
ন্যাশনাল রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট প্রণয়ন সংক্রান্ত কাজ, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ সংক্রান্ত ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেশন কমিটি ও ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, জাতীয় কৌশলপত্রের অ্যাকশন আইটেমগুলো বাস্তবায়ন, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সঙ্গে সমন্বয় ও দ্বিপক্ষীয় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নসহ কমিশনের অন্যান্য কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে মানি লন্ডারিং অনুবিভাগে পৃথক ডেস্ক স্থাপন করার জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশে পাঠানো এমএলএআরের সর্বশেষ অবস্থা পর্যালোচনা ও গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে দুদকের অনুরোধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে একজন ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত এজেন্সি টু এজেন্সি তথ্য বিনিময়ের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কে (গ্লোবাল নেটওয়ার্ক) যোগদান করার বিষয়টি বিবেচনাধীন রয়েছে।
দুদক সূত্র আরও জানায়, রাষ্ট্রপতির কাছে দেওয়া বার্ষিক প্রতিবেদনে সরকারের কাছে দুদক থেকে ৪টি সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে অর্থ বা সম্পদ পাচার রোধ এবং পাচার হওয়া অর্থ বা সম্পদ বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখতে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর অধীন সাতটি অপরাধকে দুর্নীতি দমন কমিশনের তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা। বিদেশ থেকে তথ্য/ইন্টেলিজেন্স প্রাপ্তি এবং সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়ার জন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় পারস্পরিক আইনি সহায়তা চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।
বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি নিয়ে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, মামলাগুলো চলমান রয়েছে। আদালতে দুর্নীতির মামলা প্রমাণে আগের বছরগুলোর তুলনায় আমরা অনেক এগিয়েছি। দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানের অর্থ পাচার নিয়ে বলেন, এমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই, অভিযোগ পেলে দুদক কাজ করবে।
হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশের এক পর্যবেক্ষণ নিয়ে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেন, দেশে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বাড়েনি, বরং কমেছে। তবে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বন্ধ করতে পারিনি। মামলা পরিচালনা ক্ষমতা কমেছে এটা মিথ্যা কথা। কারণ মানি লন্ডারিং মামলায় ১০০ ভাগ সাফল্য, অন্যান্য মামলায় সাজার পরিমাণ ৬৭-৭০ ভাগ আমাদের পক্ষে। আমাদের সক্ষমতা কমেছে কে এটা বলেছে। এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।
বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে দুদকে ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে ৯০১টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করে। এ ছাড়া ২২৪টি চার্জশিট অনুমোদন এবং ৪০৬টি মামলা হয়েছে।