আর মাত্র দুদিন পর পবিত্র মাহে রমজান। রমজান মাসকে সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে এখন ঊর্ধ্বগতি। এ সময় যেকোনো মাসের তুলনায় ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ে। এই বাড়তি চাহিদাকে পুঁজি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা একদিকে যেমন কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, তেমনি অন্যদিকে দাম বাড়িয়ে বাজার অস্থির করে তোলে। এতে সাধারণ মানুষের কষ্ট বেড়ে যায়।
এ প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিজনেস সামিট উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। দ্রব্যমূল্য বাড়াবেন না।’
তবে রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দ্রব্যমূল্য কিছুতেই বাগে আসছে না। ইতিহাসের সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে ব্রয়লার মুরগি। সবকিছু প্রধানমন্ত্রীর নজরে রয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা গতকাল জানিয়েছেন।
অন্যদিকে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, রমজান উপলক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, বাজার মনিটরিং ও বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে আজ বসছে নিরাপত্তা-সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সভা। কমিটির আহ্বায়ক প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সভাটি অনুষ্ঠিত হবে। এর পাশাপাশি আসন্ন গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন রাখা, বর্তমান আইন শৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি, জঙ্গি প্রশিক্ষণ তৎপরতা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠী কেএনএফ প্রসঙ্গে আলোচনা হতে পারে এ সভায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, রমজান মাসে চাহিদা অপেক্ষা মজুদ পর্যাপ্ত রয়েছে। সুতরাং সংকট হওয়ার কোনো কারণ নেই। বাজার মনিটরিং জোরদার করা হচ্ছে।
এর আগে গত বছর ২২ জুন নিরাপত্তা-সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সভা হয়। সেই সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি নিয়ে আজকে পর্যালোচনা করা হবে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। সে সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, নিত্যপণ্যের বাজার সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য ভোক্তা অধিকার অধিদফতরসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার মাধ্যমে নিয়মিত বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা হবে। এ প্রসঙ্গে অগ্রগতি নিয়ে আজ সভায় একটি রিপোর্ট উপস্থাপন করা হতে পারে। যেখানে উল্লেখ থাকবে নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। এ ছাড়াও এ বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত আছে। তবে এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পৃথক একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করবে বলে জানা গেছে।
আগের সভায় কালোবাজারি ও মজুদদারির মাধ্যমে যেন কোনো ধরনের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি না হয় সে বিষয়ে নিবিড়ভাবে মনিটর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ বিষয়ে অবশ্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, মিলগেট থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য-সামগ্রী পাইকারি বাজারে যাতে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবেশ করতে পারে সে জন্য ব্যবসায়ীদের মোটিভেশন করা হয়েছে।
জানা গেছে, নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য ঢাকা মহানগরীতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ৪২টি টিম গঠন করা হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ সব পণ্যের মূল্য নিয়ে কেউ যেন মনোপলি অবস্থার সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন কাজ করছে। ইতিমধ্যে ৪৫টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
ভোজ্য তেলের বিষয়ে গত সভায় সিদ্ধান্ত ছিল, ভোজ্য তেলের আমদানির নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে। একই সঙ্গে দেশীয় বিভিন্ন তেল শোধনাগারগুলোর কার্যক্রম আরও বৃদ্ধি করতে হবে। সে অনুযায়ী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় ও শিল্প মন্ত্রণালয় একযোগে কাজ করছে। এ ছাড়াও সয়াবিন তেল আমদানি ও জ্বালানি তেল ও ভোজ্য তেলের আমদানির বিকল্প উৎস খুঁজে বের করার জন্য সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এ ছাড়াও দেশীয় খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
গত বছরের রোজার মাসে ভোজ্য তেলের দাম ছিল লিটার প্রতি ১৫৪ টাকা। আর চলতি বছর লিটার হয়েছে ১৮৫ টাকা। ছোলা গত রোজায় দাম ছিল কেজি ৭০ টাকা। এবার দাম কেজি ৯৫ টাকা। গত রোজায় ডিম ডজন বিক্রি হয়েছে ১১০ টাকায়। আর এবার বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়। ব্রয়লার মুরগি গত রোজায় ছিল ১৫০ টাকা। আর এবার ইতিহাসে রেকর্ড তৈরি করেছে এই ব্রয়লার মুরগি। দাম ২৫০ টাকা। গরুর মাংস গত রোজায় ছিল ৬৫০ টাকা। এবার বিক্রি হচ্ছে কেজি ৮০০ টাকায়। চিনি গত রোজায় ছিল কেজি ৮০ টাকা। এবার দাম হয়েছে কেজি ১২০ টাকা। ডাল গত রোজায় ছিল কেজি ১১৫ টাকা। আর এবার দাম হয়েছে কেজি ১৩৫ টাকা। খেজুর মান ভেদে গত রোজার মাসে ছিল ১৫০ থেকে ৩৫০ টাকা। আর এবার কেজি ২০০ থেকে ৪৫০ টাকা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ৬ পণ্যের মজুদ চাহিদার দ্বিগুণ রয়েছে। চিনি বছরের চাহিদা হচ্ছে ২০ লাখ টন। মাসে চাহিদা ১ লাখ ৫০ হাজার টন। আর রোজার মাসে চাহিদা হচ্ছে ৩ লাখ টন। বর্তমানে চিনির মজুত রয়েছে ২ লাখ টন। পাইপ লাইনে রয়েছে ৫ লাখ টন।
ভোজ্য তেলের বছরে চাহিদা হচ্ছে ২০ লাখ টন। মাসে চাহিদা ১ লাখ ৫০ হাজার টন। রোজার মাসে চাহিদা হচ্ছে ৩ লাখ টন। আর পাইপ লাইনে রয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার টন।
পেঁয়াজের বছরে চাহিদা হচ্ছে ২৫ লাখ টন। মাসে চাহিদা হচ্ছে ২ লাখ টন। রোজার মাসে চাহিদা ৪ লাখ টন। মজুদ রয়েছে ২৭ লাখ ৩০ হাজার টন। ছোলা বছরের চাহিদা ১ লাখ ৫ হাজার টন। মাসে ৫ হাজার টন। রোজায় ১ লাখ টন। বর্তমান মজুদ ১ লাখ ৫০ হাজার টন। খেজুরের বছরের চাহিদা ১ লাখ টন। মাসে ৫ হাজার টন। বর্তমান মজুদ ১ লাখ ৫০ হাজার টন। মসুর ডাল বছরের চাহিদা ৬ লাখ টন। মাসে ৪০ হাজার টন। রোজায় ১ লাখ টন। মজুদ ১ লাখ ৫০ হাজার টন।
জানা গেছে, আজকের সভায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা হতে পারে। বিশেষ করে কোনো স্বার্থন্বেষী মহল যদি জ্বালাও-পোড়াও করে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ করার অপচেষ্টা চালায় তাহলে কি ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সভায় ১১ জন মন্ত্রী, ৮ জন সচিব, তিন বাহিনীর প্রধান ও পুলিশের আইজিসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
এর আগে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির দশম সভা অনুষ্ঠিত হয়। কমিটির সভাপতি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজ্জামেল হক বলেছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি রোধ করতে মোবাইল কোর্ট অভিযান জোরদার করতে হবে। একই সঙ্গে তিনি বাজার মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা জোরদার করার নির্দেশনা দেন। শুধু তাই নয়, দাম বৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেন ।