ই-পেপার বিজ্ঞাপনের তালিকা বৃহস্পতিবার ৮ জুন ২০২৩ ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
ই-পেপার বৃহস্পতিবার ৮ জুন ২০২৩
https://www.shomoyeralo.com/ad/Amin Mohammad City (Online AD).jpg

https://www.shomoyeralo.com/ad/728X90.gif
আজ বিশ্ব পানি দিবস
আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে দেশের ২ কোটি মানুষ
গোলাম মোস্তফা
প্রকাশ: বুধবার, ২২ মার্চ, ২০২৩, ১০:৪১ এএম আপডেট: ২২.০৩.২০২৩ ১১:০২ এএম | অনলাইন সংস্করণ  Count : 296

যশোরের চৌগাছা উপজেলার মাড়ুয়া গ্রামের লুৎফর রহমান (৫৮) গত ২৬ বছর ধরে আর্সেনিকে আক্রান্ত। তিনি বলেন, আমি ১৯৯৬ সালে আক্রান্ত হই। শুরুতে হাত-পায়ে ছোট ছোট গুটি দেখা দেয়। হঠাৎ করে তা বেড়ে যায়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যাই। চিকিৎসকরা জানান, আর্সেনিকের কারণে এমন হয়েছেন। 

তিনি আরও জানান, তাদের পরিবারে দুই ভাইসহ ৫ জনই আর্সেনিকে আক্রান্ত। এর মধ্যে তার বড় ভাই আক্কাস আলী আর্সেনিক থেকে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আমাদের গ্রামে অন্তত ৪০ জন আক্রান্ত এবং ২৫ জনের অবস্থা গুরুতর। কয়েক বছর আগে আমার একটা ফুসফুসও কেটে ফেলতে হয়েছে। এখন দিন দিন অবস্থা বেশি খারাপ হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সাহায্য তো দূরের কথা কোনো খোঁজখবরও নেয় না। শরীর দুর্বল লাগে, সবকিছু ভুলে যাই, কিছু খেতে পারি না। এককথায় চরম মানবেতর জীবনযাপন করছি।

সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, আর্সেনিকের মাত্রা কম রয়েছে এমন এলাকার তুলনায় আর্সেনিকের মাত্রা বেশি এমন এলাকার মানুষের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, মেটাবোলিক সিনড্রোম, বুদ্ধি বৈকল্য ও অ্যাজমা বেশি হচ্ছে। আর্সেনিকের মাত্রা বেশি এমন এলাকায় উচ্চ রক্তচাপ রোগীর শতকরা হার ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রবণতা কম এমন এলাকায় ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। ডায়াবেটিস রোগীর হার ১২ দশমিক ৪ শতাংশ। আর আর্সেনিকের মাত্রা কম এমন এলাকায় ২.২ শতাংশ। মেটাবোলিক সিনড্রোম আর্সেনিক-প্রবণতা বেশি এমন এলাকায় ৩১ দশমিক ৮ শতাংশ ও কম এমন এলাকায় ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ। বুদ্ধি বৈকল্য-প্রবণতা বেশি এমন এলাকায় ২৬ দমমিক ৭ শতাংশ আর কম রয়েছে এমন এলাকায় ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। আর্সেনিক-প্রবণ এলাকায় ১০.৩ শতাংশ অ্যাজমা, কম এমন এলাকায় ১.৬ শতাংশ। এমন প্রেক্ষাপটে আজ বুধবার ‘বিশ্ব পানি দিবস’। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো নানা আয়োজনে বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হবে।

আর্সেনিক উপদ্রুত এলাকায় সাধারণ মানুষের জন্য জরুরিভিত্তিতে আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ খাবার পানি যেমন নিশ্চিত করতে হবে তেমনি দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) ২০১৯ সালের গুচ্ছ জরিপের তথ্য অনুযায়ী দেশের ১১ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে। সেই হিসাবে প্রায় ২ কোটি মানুষ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে।

এদিকে, দেশের নলকূপে আর্সেনিকের মানমাত্রা নিয়ে করা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের (ডিপিএইচই) সমীক্ষার তথ্য বলছে, দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে আর্সেনিকের হার সবচেয়ে বেশি। এখনও ২৫ শতাংশের বেশি আর্সেনিক পাওয়া যাচ্ছে চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, নোয়াখালী, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর ও সাতক্ষীরা জেলার নলকূপগুলোতে। 

সমীক্ষায় দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি চাঁদপুর জেলায় ৪১ শতাংশ নলকূপে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক রয়েছে। এরপর গোপালগঞ্জ ও সাতক্ষীরা জেলায় ৩৫ শতাংশ, ৩২ শতাংশ পাওয়া গেছে লক্ষ্মীপুরে, ২৯ শতাংশ নোয়াখালী, ২৮ শতাংশ কুমিল্লা ও ২৬ শতাংশ ফেনী জেলায় পাওয়া গেছে। সবচেয়ে কম আর্সেনিকযুক্ত নলকূপ রয়েছে, বরিশাল, নওগাঁ, দিনাজপুর, গাজীপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, পিরোজপুর ও ঝালকাঠি জেলায়।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের (ডিপিএইচই) আওতায় পানি সরবরাহে আর্সেনিক ঝুঁকি নিরসন প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী বিধান চন্দ দে সময়ের আলো বলেন, ৫৪ জেলার মোট ৭২ লাখ নলকূপে আর্সেনিক স্ক্রিনিং করা হয়। এর মধ্যে ১৪ শতাংশ নলকূপে আর্সেনিক পাওয়া গেছে। ২০০৩ সালে এই হার ছিল ৩৫ শতাংশ।
তিনি বলেন, দেশের মানুষ আগের চেয়ে অনেকটা সচেতন হয়েছে। এখন অগভীর নলকূপ সংখ্যায় খুব কম। এলাকা ভেদে কোথাও ৫৫০ ফুট, কোথাও আবার ৭৫০ ফুট গভীরে থেকে আর্সেনিক নেই এমন পানি পাওয়া যাচ্ছে।

তিন বছর ধরে আর্সেনিকে আক্রান্ত যশোরের শার্শা উপজেলার সাথী আকতার (৩৫)। তিনি জানান, শুরুতে হাত-পায়ে ছোট ছোট গুটি দেখা দেয়। তখন বুঝতে পারিনি। কিন্তু হঠাৎ করে তা বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যাই। চিকিৎসকরা জানান, আর্সেনিকের কারণে এমন হয়েছে।

তিনি জানান, আমার বাবা জহুর আলী আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে ৮ বছর আগে মারা গেছেন। আমার মা ছকিনা বেগমও ৩০ বছর ধরে আক্রান্ত। আমার ভাইও আক্রান্ত। আমাদের গ্রামের অনেকেই আক্রান্ত। আর্সেনিক হওয়ার কারণে শরীর দুর্বল লাগে, সবকিছু ভুলে যাই, কিছু খেতে পারি না। টাকার অভাবে ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে পারি না।

আর্সেনিক নিয়ে যশোর কাজ করা বেসরকারি সংগঠন এশিয়া আর্সেনিক নেটওর্য়াক, বাংলাদেশের ম্যানেজার তরুণ কান্তি হোড় সময়ের আলোকে বলেন, আমরা আর্সেনিক রোগীদের নিয়ে কাজ করছি। কিন্তু নতুন করে কোনো সার্ভে নেই। তাই নতুন রোগী বাড়ছে কি না বলা সম্ভব নয়। ফলে নতুনদের কোনো স্ক্রিনিং করা হচ্ছে না। আর হাসপাতালগুলোতে এখন আর সেই ব্যবস্থা নেই। সর্বশেষ ২০১৯ সালে যশোর সদরের এক গ্রামে দেখেছি ৯ জন আক্রান্ত।। মূলত আমরা পুরোনো রোগীদের নিয়ে কাজ করছি। 

আর্সেনিকের ভয়াবহতা তুলে ধরে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্বদ্যিালয়ের অধ্যাপক ড. এ ফয়েজ মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন সময়ের আলোকে বলেন, আর্সেনিক মূলত মাটির নিচে থাকে। আমরা ডিপটিউবওয়েলের মাধ্যমে নিচের পানিগুলো তুলে ফেলছি। আমরা খাল, বিল, পুকুর নদী-নালা এগুলোর পানির ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছি। ফলে নিচে যে আর্সেনিকগুলো থাকে তা গভীর নলকূপের মাধ্যমে ওপরে চলে আসছে। খরা মৌসুমে সেচ দিয়ে ধান বা অন্যান্য খাদ্যশস্য উৎপাদনের সময় সেচের পানির সঙ্গে মাটির গভীরের আর্সেনিক ফসলি জমিতে চলে আসে। সেসব ফসলের খাবার খাওয়ার মাধ্যমে মানুষ আর্সেনিকে আক্রান্ত হচ্ছে। 

তিনি বলেন, আর্সেনিক হলো হেবি মেটাল পদার্থ। ফলে কিডনি কখনো হজম করতে পারে না। যার প্রভাবে পায়ের তলায় ক্ষত তৈরি হয়, হাতে ফুসকা উঠে মনে হয় যেন বসন্ত হয়েছে। শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। এগুলোই হচ্ছে আর্সেনিকের লক্ষণ। যেসব এলাকায় আর্সেনিক বেশি তাদের মধ্যে হাতে-পায়ে অনেক ক্ষত দেখা যায়, তারা সবাই আর্সেনিক আক্রান্ত। যাদের ডায়াবেটিস কিংবা রক্তচাপজনিত সমস্যা থাকে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের অবস্থা আরও ভয়ানক হতে থাকে।

দেশে বিগত ২৫ বছর ধরে আর্সেনিক বিষক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. খালেদ হোসেন। তিনি সময়ের আলোকে বলেন, আর্সেনিক বিষক্রিয়া বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি অন্যতম প্রধান হুমকি। সারা বিশ্বের প্রায় ১৪ কোটি মানুষ আর্সেনিক বিষক্রিয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। আর্সেনিক বিষক্রিয়ার প্রধান কারণ, পানি পানের মাধ্যমে সহনশীল মাত্রার (১০ মাইক্রোগ্রাম/লিটার) চেয়ে অধিক মাত্রায় আর্সেনিক গ্রহণ। আর্সেনিক দূষণ আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, তাইওয়ান, চিলি, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, মঙ্গোলিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান, চীন এবং থাইল্যান্ড। এর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে ভয়াবহ আর্সেনিক বিপর্যয়ের শিকার।

তিনি বলেন, আর্সেনিক মূলত এক প্রকার রাসায়নিক উপাদান। পানিতে স্বল্প মাত্রায় আর্সেনিক সব সময়ই থাকে। কিন্তু যখনই এই মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে বেশি হয়ে যায় তখনই তা পানকারীর শরীরের নানা রকম রোগের উপসর্গ তৈরি করে এবং পরবর্তীতে সেসব রোগব্যাধিকে মারাত্মক পর্যায়ে নিয়ে যায়।

ড. মো. খালেদ হোসেন বলেন, আমি ৬-৭ বছর আগে যখন আর্সেনিক নিয়ে কাজ শুরু করি তখন আর্সেনিক আক্রান্ত এলাকায় উচ্চ রক্তচাপের শনাক্তের হার ছিল ১৪ শতাংশ। আর এখন সেই শনাক্তের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশ। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে রোগের প্রকোপ কতটা ভয়াবহ বেড়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে আর্সেনিক আক্রান্ত এলাকায় অ্যাজমা, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যানসারের ঝুঁকি এবং মৃত্যুও বাড়ছে। 

তিনি বলেন, দেশে আর্সেনিকের মূল উৎস হলো নলকূপের পানি। নলকূপ বা টিউবওয়েল আর্সেনিক শনাক্ত হওয়ার পদ্বতি খুবই সহজ। কিন্তু স্ক্রিনিং করা হচ্ছে না। কিছু দিন পর পর যদি স্ক্রিনিং করা যেত তাহলে মানুষ বুঝত কোন নলকূপের পানিতে আর্সেনিক আছে আর কোনটাতে নেই। তাহলে মানুষ কিন্তু ওইসব পানি পান করত না। আমাদের মানুষের জীবনমানের অনেক উন্নতি হলেও আমরা আর্সেনিকের ব্যাপারে সবাই উদাসীন। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কেউই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছি না। আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীদের নিয়মিত ডাক্তারি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা, ক্ষেত্রবিশেষে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট জাতীয় ওষুধ সরবরাহ করা। কিন্তু কোনো কার্যকর এবং টেকসই পদক্ষেপ নেই। তাই সচেতনতা বাড়াতে হবে, যার কোনো বিকল্প নেই।


https://www.shomoyeralo.com/ad/780-90.jpg



https://www.shomoyeralo.com/ad/Google-News.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড
এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫। ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com