ডা. নিজাম উদ্দীন আহম্মেদ
একটি দেশের উন্নতি অনেকখানি নির্ভর করে জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনীতির ওপর। কিন্তু বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতির জন্য তামাক ও তামাকজাত পণ্য একটি বড় হুমকি। পৃথিবীতে প্রতি বছর ৮০ লাখের বেশি মানুষ তামাক ব্যবহারের কারণে মারা যায়, যার মধ্যে শুধু আমাদের দেশেই প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ তামাক ব্যবহারের কারণে মারা যায়। ১৪৮টি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ধূমপায়ীর দিক থেকে আমাদের অবস্থান অষ্টম। তা ছাড়া তামাকের কারণে বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এই হুমকি মোকাবিলা করতে হলে আমাদের তামাকজাত পণ্যের কর এবং মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে তামাকের ব্যবহার কমাতে হবে।
তামাক ও তামাকজাত পণ্য আমাদের জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ওপর বিরাট নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তামাকজাত পণ্যের দাম বাড়ালে মানুষের তামাকপণ্য কেনার ক্ষমতা কমবে এবং তামাক ব্যবহারের প্রবণতা কমে আসবে। এর ফলে মানুষের তামাকজনিত অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর ঝুঁকিও হ্রাস পাবে। তা ছাড়া তামাকপণ্যের ওপর উচ্চ হারে আরোপিত কর দেশের রাজস্ব বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
কিন্তু তামাকপণ্যের ওপর কর উচ্চ হারে না বাড়ালে তামাক নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। বাংলাদেশে বিড়ি/সিগারেটের দাম যে হারে বাড়া উচিত সেই হারে বাড়ছে না। বিশেষ করে নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম না বাড়ায় এ খাত থেকে আশানুরূপ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বিভিন্ন স্তরের সিগারেটের ১০ শলাকার একেকটি প্যাকেটের যে মূল্য ঘোষণা করা হয়েছে, বাজারে তার চেয়ে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেশি মূল্যে সিগারেট বিক্রি করা হচ্ছে।
যেমন : নিম্ন স্তরের ১০ শলাকার সিগারেটের একটি প্যাকেটে মূল্য ৪০ টাকা লেখা থাকলেও দেখা যাচ্ছে তা বাজারে খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। অথচ সিগারেট কোম্পানিগুলো রাজস্ব বোর্ডকে কর দিয়েছে ঘোষিত খুচরা মূল্য হিসাবেই অর্থাৎ ৪০ টাকা হিসাবে। সব স্তরের সিগারেটের জন্যই এ কথা প্রযোজ্য। ফলে চলতি অর্থবছরে এভাবে সিগারেট কোম্পানিগুলোর প্রায় ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ থেকে যাচ্ছে।
অনেকে বিভান্তিকর তথ্য ছড়ান যে, সিগারেটের দাম বাড়ানো হলে নিম্ন আয়ের যে পরিবারগুলো সিগারেট ব্যবহার করছে তাদের সিগারেট ব্যবহার আগের মাত্রায় ধরে রাখার জন্য খাদ্যপণ্য ক্রয় করা কমিয়ে আনবে কিন্তু ২০২১ সালে ‘উন্নয়ন সমন্বয়’ পরিচালিত এক জরিপ থেকে দেখা গেছে ওই সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। অন্যদিকে তামাক কোম্পানিগুলো প্রচারণা চালায় যে, বিড়ি/সিগারেট বিক্রি কমে গেলে এ শিল্পে কর্মসংস্থান হ্রাসের ফলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে ক্ষতি হবে, কিন্তু ওই আশঙ্কাও অমূলক। কারণ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক জরিপ থেকে দেখা গেছে যে, বিড়ি শিল্পে যুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা মাত্র ৪৭ হাজার। এর সঙ্গে সিগারেট শিল্পে যুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা এক করে হিসাব করলে যা পাওয়া যায় তা দেশের আনুষ্ঠানিক খাতে যুক্ত শ্রমিক সংখ্যার ১ শতাংশেরও কম।
তদুপরি তামাকজাত পণ্যের ওপর উচ্চ হারে করারোপ সরকারের জন্য উল্লেখযোগ্য হারে রাজস্ব বৃদ্ধি করতে পারে। একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, যদি আমরা কর ব্যবস্থার সংস্কার করে সুনির্দিষ্ট করারোপ করি এবং সব ব্র্যান্ডের সর্বনিম্ন মূল্যবৃদ্ধি করি তা হলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আয় করা সম্ভব হবে, যা বর্তমানে সংগৃহীত রাজস্বের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি। তামাক কর থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব তামাকবিরোধী জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে, বিশেষ করে যুবক এবং নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি তামাক ব্যবহারের প্রবণতা কমাতে সাহায্য করবে, যা দীর্ঘমেয়াদে জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক উন্নতিতে ভূমিকা রাখবে।
তা ছাড়া উচ্চ তামাক কর মানুষকে তামাকজাত পণ্য ব্যবহার থেকে নিরুৎসাহিত করবে, বিশেষ করে তরুণ এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী যাদের ক্রয়ক্ষমতার ওপর মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়ে। উচ্চ তামাক কর আরোপের ফলে তামাক ব্যবহারের প্রবণতা কমে আসবে এবং তামাকজনিত অসংক্রামক রোগ ও মৃত্যু হ্রাস পাবে।
তামাক ও তামাকজাত পণ্য আমাদের জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ওপর বিরাট নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তামাকজাত পণ্যের দাম বাড়ালে মানুষের তামাকপণ্য কেনার ক্ষমতা কমবে এবং তামাক ব্যবহারের প্রবণতা কমে আসবে। এর ফলে মানুষের তামাকজনিত অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর ঝুঁকিও হ্রাস পাবে। তা ছাড়া তামাকপণ্যের ওপর উচ্চ হারে আরোপিত কর দেশের রাজস্ব বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশে তামাকজনিত অসংক্রামক রোগের মৃত্যুর ঝুঁকি কমিয়ে আনতে তামাক কর বৃদ্ধি একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বাজেটে সব স্তরের সিগারেটের দাম নির্ধারণ করে থাকে। আসন্ন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে নিম্নস্তরের (কম দামি) সিগারেটের দাম বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই উচ্চস্তরের পাশাপাশি নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম বৃদ্ধি না করলে রাজস্ব আয় কমার পাশাপাশি ধূমপায়ীর সংখ্যা বৃদ্ধির আশঙ্কাও বেড়ে যায়।
তামাক কর বৃদ্ধি শুধু জনস্বাস্থ্যের উন্নতিই করতে পারে না বরং রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাতেও সহায়তা করতে পারে। তাই নীতিনির্ধারকদের উচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যকে সামনে রেখে দেশের অর্থনীতি এবং জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাকপণ্যে উচ্চ হারে কর আরোপ করা, যা দেশের রাজস্ব বৃদ্ধি করতে এবং ধূমপায়ীর সংখ্যা কমাতে সহায়তা করবে বলে আমার বিশ্বাস।