যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ মানুষই মনে করছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ মানবসভ্যতাকে হুমকিতে ফেলতে পারে। সেখানকার ৬১ শতাংশ নাগরিকের বিশ্বাস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানবতার জন্য হুমকি। বুধবার ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও ইপসোসের প্রকাশিত এক মতামত জরিপে এই আভাস মিলেছে।
জরিপের ফল বলছে, দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আমেরিকান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন। উল্লেখ্য, রয়টার্স-ইপসোসের এই অনলাইন মতামত জরিপে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্ক ৪ হাজার ৪১৫ জন নাগরিক অংশ নিয়েছেন। গত ৯ থেকে ১৫ মে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ক মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের চ্যাটবট হলো চ্যাটজিপিটি। রয়টার্সের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এটি সর্বকালের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অ্যাপ্লিকেশন হয়ে উঠেছে। যে কারণে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপক একীভূতকরণ ঘটেছে। এই বাস্তবতা নতুন এই প্রযুক্তিকে জনসাধারণের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। আইনপ্রণেতা এবং এআই কোম্পানিগুলোও উদ্ভাবিত এই নতুন প্রযুক্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন। এআই নিয়ে সৃষ্ট উদ্বেগ ও এর সম্ভাবনা-শঙ্কার বিষয়ে মঙ্গলবার মার্কিন কংগ্রেসের এক শুনানিতে ছিলেন ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) স্যাম অল্টম্যান। এই প্রযুক্তির সম্ভাব্য অপব্যবহারের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন। মার্কিন সিনেটর কোরি বুকার ওই শুনানিতে বলেছেন, ‘এই দৈত্যকে বোতলে রাখার কোনো রাস্তা নেই। বিশ্ব জুড়ে এর বিস্ফোরণ ঘটছে।’ এআইকে কীভাবে সর্বোত্তম উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেই বিষয়ে সিনেটের কোরি এমন মন্তব্য করেছেন।
রয়টার্স-ইপসোসের জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৬১ শতাংশ মনে করেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানবতার জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। আর এই মন্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন মাত্র ২২ শতাংশ মানুষ। আসলে এই ধারার বুদ্ধিমত্তা মানবতার জন্য ঝুঁকি কি না, সে সম্পর্কে নিশ্চিত নন ১৭ শতাংশ মানুষ।
২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যারা রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বেশি উদ্বেগ দেখা গেছে বলে জরিপে উঠে এসেছে। জরিপের ফলে দেখা যায়, মানবতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে বলে মনে করেন ট্রাম্পকে ভোট দেওয়া ৭০ শতাংশ ভোটার। অন্যদিকে জো বাইডেনকে ভোট দেওয়া ভোটারদের ক্ষেত্রে এই হার ৬০ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতিবিষয়ক সংস্থা ফিউচার অব লাইফ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ল্যান্ডন ক্লেইন। তিনি বলেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়ে আমেরিকানদের ব্যাপক মাত্রার উদ্বেগের কথা বলছে এই জরিপ। সংস্থাটি মার্কিন ইলেক্ট্রিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলার সিইও ইলন মাস্কের লেখা এক খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছে। সেই চিঠিতে এআইয়ের গবেষণায় ছয় মাসের বিরতি দাবি করা হয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা এই মুহূর্তটিকে পারমাণবিক যুগের সূচনার মতো করেই দেখি এবং আমাদের কাছে জনসাধারণের বোঝাপড়ার তথ্য রয়েছে; যা এআইয়ের লাগাম টানতে পদক্ষেপ নেওয়ার জরুরতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।’
এই ইন্ডাস্ট্রিতে যারা কাজ করছেন; তারা অবশ্য বলছেন, মানুষ এআই প্রযুক্তির ইতিবাচক দিকগুলো নিয়ে আরও ভাবা দরকার। ‘উদ্বেগ খুবই যথার্থ, তবে প্রথমেই যেটা ভাবা উচিত যে কেন আমরা এটা ব্যবহার করছি।’ রয়টার্সকে বলেছেন স্টানফোর্ডের কম্পিউটার সায়েন্সের অধ্যাপক সেবাস্তিয়ান থ্রুন। ‘এএই মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করবে, মানুষকে আরও প্রতিযোগিতামুখর ও দক্ষ হতে সহায়তা করবে’, মত দিয়েছেন তিনি।
ইউসি বার্কেলের অধ্যাপক ইয়ন স্টোয়িকা মাদক অনুসন্ধানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘আমেরিকানরা সম্ভবত বুঝতে পারছে না, ইতিমধ্যেই এআই তাদের দৈনন্দিন ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে।’
অবশ্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ঝুঁকি নিয়েও সরব বিশ্লেষকরা। ক্যামব্রিজ বিশ্ব বিদ্যালয়ের ড. সিয়ান ও হেইগার্টারিক মনে করেন, এই প্রযুক্তির অপব্যবহার ভয়াবহ পরিস্থিতি ডেকে আনতে পারে। ‘যেমন করে তুমি দ্রুত একটি রচনা লিখতে পারবে, তেমন করেই তুমি ভিন্নভিন্ন সম্প্রদায়কে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে মিথ্যে প্রচারণাও তৈরি করতে পারবে দ্রুততার সঙ্গে। যা অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে।’