দেশের পাহাড়ি এলাকাগুলোয় পানির উৎসের বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় এখনও নির্ভর করতে হয় প্রাকৃতিক ছড়া, ঝিরি ও কুয়ার পানির ওপর। কিন্তু বর্তমানে এসব উৎস শুকিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ তো দূরে থাক, অন্যান্য ব্যবহারের জন্য একটু পানি সংগ্রহেও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের মধ্যম সোনাইছড়ি ত্রিপুরাপাড়ার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের পায়ে হেঁটে দূর-দূরান্তে যেতে হচ্ছে।
এ অবস্থায় তারা পানিবাহিতসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এ কারণে প্রতি বছর প্রাণহানির ঘটনাও কম ঘটছে না। তবে এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। সচেতন মহল বলছে, বিভিন্ন কোম্পানি গভীর নলকূপ দিয়ে তাদের কারখানা ও স্থাপনায় পানি সরবরাহ করায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেছে। তাই পানি সুরক্ষায় দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। সেচ প্রকল্প বা পাহাড়ি ঝরনা ও ছড়াতে বাঁধ দিয়ে অথবা পাহাড়ে বাঁধ দিয়ে বর্ষাকালে পানি সংরক্ষণ করে তা সাধারণ জনগণ ও শিল্প-কারখানায় সরবরাহ করা যায়। তা হলে গভীর নলকূপের ব্যবহার কমে যাবে ও পানির স্তর ওপরে উঠে আসবে। তা ছাড়া পানির ব্যবহার, খরচ ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত শিক্ষা গ্রহণে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
সীতাকুণ্ডের মধ্যম সোনাইছড়ি ত্রিপুরাপাড়ার ২০১৭ সালের ১২ জুলাইয়ে হাম রোগে আক্রান্ত হয়ে ৯ শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড় শুরু হলে তৎকালীন জেলা প্রশাসকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি আসে। এর মধ্যে ছিল নলকূপ স্থাপন, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নির্মাণ, বিদ্যুৎ ও রাস্তা মেরামতসহ বেশ কয়েকটি উন্নয়ন কাজ। এতে ত্রিপুরাপাড়ার বাসিন্দাদের মধ্যে আশার আলো দেখা দিলেও ছয় বছরেও এসব বাস্তবায়ন হয়নি। ঘোষণার কয়েক সপ্তাহ পর ত্রিপুরাপল্লীতে গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ শুরু হলেও তা মাঝপথেই বন্ধ হয়ে যায়। আর সে কারণে ভোগান্তিতে পড়ে এই এলাকার ৭০টি পরিবার।
ত্রিপুরাপাড়ার সর্দার সুজন ত্রিপুরা বলেন, উপজেলার বারৈয়াঢালা, কুমিরা, সোনাইছড়ি, বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়ন ও সীতাকুণ্ড পৌরসভায় প্রায় আড়াই হাজার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস। প্রতিটি এলাকায় চলছে পানির জন্য হাহাকার।
কুমিরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমার এলাকার প্রায় ৪৫টি আদিবাসী পরিবারে পানির অভাব দেখা দিয়েছে। বিশুদ্ধ পানি দূরে থাক, খাল-বিল ও ডোবায় ময়লা পানিও পাওয়া যাচ্ছে না।’
সীতাকুণ্ড পৌরসভার মেয়র আলহাজ মুক্তিযোদ্ধা বদিউল আলম বলেন, পানির জন্য আমার এলাকার ৩৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিবারের শিশু, নারী, পুরুষ খুবই কষ্ট করছে। চন্দ্রনাথ পাহাড় ও ইকোপার্ক এলাকায় কৃত্রিম উপায়ে ঝরনার পানিকে বিশুদ্ধকরণের মাধ্যমে খাবার পানি সরবরাহের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠিও পাঠানো হয়েছে। এটি হলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং পৌরবাসীর পানির সংকট অনেকটাই নিরসন হয়ে যাবে।
সীতাকুণ্ড নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সদস্য সচিব মোহাম্মদ গিয়াসুদ্দীন বলেন, ‘সীতাকুণ্ডের শিল্প-কারখানাগুলো বিশেষ করে স্টিল মিলগুলোতে অনেক পানির প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে জিপিএইচ, বিএসআরএম, কেএসআরএম গভীর নলকূপ দিয়ে পানি উত্তোলন করছে। ফলে পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে।’ কীভাবে এ সমস্যা সমাধান হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পানির বিকল্প উৎস সন্ধান করতে হবে। যেমন বিএসআরএম স্টিল জোরারগঞ্জ মুহুরি প্রজেক্ট থেকে পাইপ দিয়ে পানি আনছে। সীতাকুণ্ডের ছোটদরগারহাট সেচ প্রকল্প বা পাহাড়ি ঝরনা ও ছড়াতে বাঁধ দিয়ে অথবা পাহাড়ে বাঁধ দিয়ে বর্ষাকালে রিজার্ভারে পানি সংরক্ষণ করে তা জনগণ ও শিল্প-কারখানায় সরবরাহ করা যায়। তা হলে গভীর নলকূপের ব্যবহার কমে যাবে এবং পানির স্তর ওপরে উঠে আসবে।
চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের ভৌত রসায়ন বিভাগের ড. শামীম আখতার বলেন, ‘বাংলাদেশের পানি সুরক্ষায় দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা উচিত। পানি সংরক্ষণের নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পাশাপাশি বর্জ্য পানির পুনর্ব্যবহার ও জলাধারসহ জল সংগ্রহ পদ্ধতির উন্নতি সাধন ও পানি সরবরাহ কিংবা বিতরণ অবকাঠামো উন্নত করে করপোরেট পানি পদভার সংকুচিত করতে হবে। তা ছাড়া পানির ব্যবহার, খরচ ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত শিক্ষা গ্রহণ করা দরকার। রিসার্চ ও উন্নয়ন-উদ্ভাবন গবেষণার প্রয়োজন আছে।’
সীতাকুণ্ডের উপজেলা জনস্বাস্থ্য উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. রাশেদুজ্জামান বলেন, ত্রিপুরাপাড়ায় গভীর নলকূপ স্থাপনের জন্য দুটি কূপ খননের পর পানি না পাওয়ায় কাজ ফেলে চলে গেছেন ঠিকাদাররা। বিষয়টি নির্বাহী প্রকৌশলীকে জানানোর পর তার নির্দেশনা অনুযায়ী পাড়ার নিচের সমতল জায়গায় দুটি নলকূপ বসানো হয়। তবে তার একটি বসানোর সপ্তাহখানেকের মধ্যে অকেজো হয়ে যায়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, ত্রিপুরাপাড়ার বাসিন্দাদের জীবনমান উন্নয়নে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনার পর করণীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।