ই-পেপার বিজ্ঞাপনের তালিকা  বুধবার ৩১ মে ২০২৩ ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
ই-পেপার  বুধবার ৩১ মে ২০২৩
https://www.shomoyeralo.com/ad/Amin Mohammad City (Online AD).jpg

https://www.shomoyeralo.com/ad/780-90.jpg
এক ফোঁটা পানির জন্য
শোয়েব সর্বনাম
প্রকাশ: শুক্রবার, ২৬ মে, ২০২৩, ২:৪২ এএম | অনলাইন সংস্করণ  Count : 55

পাহাড়ি মানুষের কাছে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের একটি প্রধান অংশ হলো সুপেয় পানি। পাহাড়ি এলাকায় পানির স্তর নিচে থাকায় নলকূপ স্থাপন করা ওখানে খুবই কষ্টকর, কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রায় অসম্ভব। কোনো রকমে নলকূপ স্থাপন করা গেলেও শুষ্ক মৌসুম আসতে না আসতেই তা অকেজো হয়ে যায়। তাই পাহাড়ি জনগোষ্ঠী সুপেয় পানির জন্য পুরোটাই প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। 

পাহাড়ে বসবাসরত জনগোষ্ঠীদের সংগ্রামী জীবনে রয়েছে টিকে থাকার লড়াই। এ লড়াইয়ে কখনো তারা বিজয়ের হাসি হাসে, কখনো বা ব্যর্থতা তাদের গ্রাস করে। এ সাফল্য বা ব্যর্থতা পুরোটাই নির্ভর করে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর এক ও একমাত্র সম্বল প্রকৃতির ওপর। আর প্রকৃতির সঙ্গে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর লড়াইয়ের অন্যতম একটি বিষয় হচ্ছে বিশুদ্ধ পানি।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বেড়েছে সুপেয় পানির সংকট। প্রতি বছর গ্রীষ্মের এ সময় পাহাড়ে পানির সংকট ভয়াবহ রূপ নেয়। শুকিয়ে যায় পাহাড়ি ছড়া, ঝরনা, খাল-বিল। এর প্রভাব পড়েছে রাঙামাটির ১০ উপজেলার বিভিন্ন দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে। সময়ের আলোতে এ সংক্রান্ত একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। 

জেলার বরকল, লংগদু, বাঘাইছড়ি, নানিয়ারচর, বিলাইছড়িসহ সদর উপজেলার কয়েকটি দুর্গম এলাকায় দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির সংকট। প্রতি বছর এ সময় পানির সংকট দেখা দেয়। বিশেষ করে বিজু উৎসবের সময় এই সংকট তীব্র হয়। এখানে নলকূপ ও রিংওয়েল বসিয়ে পানি পাওয়া খুবই কঠিন। 

বিভিন্ন কোম্পানি গভীর নলকূপ দিয়ে তাদের কারখানা ও স্থাপনায় পানি সরবরাহ করায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেছে। তাই পানি সুরক্ষায় দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। সেচ প্রকল্প বা পাহাড়ি ঝরনা ও ছড়াতে বাঁধ দিয়ে অথবা পাহাড়ে বাঁধ দিয়ে বর্ষাকালে পানি সংরক্ষণ করে তা সাধারণ জনগণ ও শিল্প-কারখানায় সরবরাহ করা যায়। তা হলে গভীর নলকূপের ব্যবহার কমে যাবে ও পানির স্তর ওপরে উঠে আসবে। তা ছাড়া পানির ব্যবহার, খরচ ও ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত শিক্ষা গ্রহণে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

সীতাকু-ের মধ্যম সোনাইছড়ি ত্রিপুরাপাড়ার ২০১৭ সালের ১২ জুলাইয়ে হাম রোগে আক্রান্ত হয়ে ৯ শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড় শুরু হলে তৎকালীন জেলা প্রশাসকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি আসে। এর মধ্যে ছিল নলকূপ স্থাপন, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নির্মাণ, বিদ্যুৎ ও রাস্তা মেরামতসহ বেশ কয়েকটি উন্নয়ন কাজ। এতে ত্রিপুরাপাড়ার বাসিন্দাদের মধ্যে আশার আলো দেখা দিলেও ছয় বছরেও এসব বাস্তবায়ন হয়নি। ঘোষণার কয়েক সপ্তাহ পর ত্রিপুরাপল্লীতে গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ শুরু হলেও তা মাঝপথেই বন্ধ হয়ে যায়। আর সে কারণে ভোগান্তিতে পড়ে এই এলাকার ৭০টি পরিবার।

ত্রিপুরাপাড়ার সর্দার সুজন ত্রিপুরা বলেন, উপজেলার বারৈয়াঢালা, কুমিরা, সোনাইছড়ি, বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়ন ও সীতাকু- পৌরসভায় প্রায় আড়াই হাজার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস। প্রতিটি এলাকায় চলছে পানির জন্য হাহাকার। 

পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় গত জুন মাসে হঠাৎ ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়। বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার দুর্গম চারটি গ্রামেই ডায়রিয়ায় মৃত্যু হয় ১০ জনের। তারা সবাই ম্রো জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়ায় এমন মৃত্যুর ঘটনা দুর্গম পাহাড়ে নতুন নয়।

বর্ষাকালে যখন নদী, ঝিল, ঝরনা, ছড়া পানিতে পূর্ণ থাকে তখন পাহাড়িদের সুপেয় পানির তেমন অভাব হয় না। ঝিরিতে পাথরের বাঁধ স্থাপন করে তারা পানি সঞ্চয় করে রাখেন, কোনো কোনো জায়গায় প্রাকৃতিকভাবেই তৈরিকৃত পাথরের স্তূপে পানি জমে থাকে আর এই পানিই তারা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু গ্রীষ্মকালে যখন প্রচণ্ড তাপে নদী ও ঝিরির পানি শুকিয়ে যায়, তখন পাহাড়ে দেখা যায় তীব্র পানি সংকট। একটুখানি বিশুদ্ধ পানির জন্য মাইলের পর মাইল তাদের পাড়ি দিতে হয়, তবুও বিশুদ্ধ পানি পাওয়া নিয়ে থাকে অনিশ্চয়তা। বিশুদ্ধ পানির অভাবে তখন তাদের নদী ও ঝিরির তলানিতে অনেক দিন ধরে জমে থাকা পানি পান করতে হয়। ফলে দেখা যায় ডায়রিয়া, আমাশয়সহ নানা রকম পানিবাহিত রোগ।  

পাহাড় ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ সুপেয় পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের সুবিধা থেকে এখনও অনেক পিছিয়ে। যদিও সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৯৮ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পায়। আর যৌথভাবে ব্যবহারসহ ৭৮ ভাগ মানুষের স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের ব্যবস্থা আছে। তবে পার্বত্য এলাকার দুর্গম পাহাড়ের বাস্তবতা ভিন্ন। বছরে ছয় মাস খাওয়ার পানির জন্য চরম কষ্ট করতে হয়। দুই থেকে তিন কিলোমিটার হেঁটে ছোট ঝিরি থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। দুই কলস পানি আনতে দুই থেকে তিন ঘণ্টা লাগে।

সামাজিক নানা সূচকে বাংলাদেশের অর্জন এখন বিশ্ব স্বীকৃত। কিন্তু দেশের ৫০টির বেশি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ লাখ মানুষ স্বাস্থ্য, শিক্ষার সুবিধায় পিছিয়ে আছে। করোনার প্রকোপ এসব মানুষকে আরও নাজুক অবস্থায় ফেলেছে। জাতিসংঘ ২০১৫ সালে এসডিজি গ্রহণ করে। এটি ১৫ বছর মেয়াদি। এতে ১৭ লক্ষ্য ও ১৬৯ সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। লক্ষ্যগুলোর মধ্যে দারিদ্র্য দূর করা, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সুস্বাস্থ্য, উন্নত শিক্ষা নিশ্চিত ও লিঙ্গবৈষম্য প্রতিরোধ অন্যতম। সবার জন্য পানি ও স্যানিটেশন সুবিধা নিশ্চিত করাও একটি লক্ষ্য।

পরিবেশবিদরা মনে করেন, এমনিতে শুষ্ক মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায়। তার ওপর পাহাড়ে গাছপালা নিধন, নির্বিচারে পাথর উত্তোলন ও সনাতন পদ্ধতির চাষাবাদে পানির উৎস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সব ঝিরি-ছড়া শুকিয়ে গেলে একসময় তীব্র পানি সংকট দেখা দেবে পাহাড়ে। অবৈধ পাথর উত্তোলন ও অপরিকল্পিতভাবে গাছ কেটে বন উজাড় করায় পানির উৎস বন্ধ হয়ে গেছে। ঝিরি-ছড়াগুলো শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। জেলার বিভিন্ন এলাকায় এ পর্যন্ত তিন শতাধিক ঝিরি-ঝরনা ও ছড়া মরে গেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই সংখ্যাটা দিন দিন আরও বাড়তে থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

পাহাড়ি অঞ্চলে ঝিরি ও নদীর পানি সঞ্চয়ের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে পাহাড়ি বন ও পাথর। প্রাকৃতিকভাবে তৈরিকৃত এই পাথরগুলো প্রাকৃতিক উপায়ে পানি সংরক্ষণ ও সঞ্চয় করে থাকে। আর এই সঞ্চয়কৃত পানি পাহাড়ি জনগোষ্ঠী দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করে। কিন্তু বর্তমান সময়ে অবাধে পাথর উত্তোলনের কারণে পানি সঞ্চয়ের এ প্রাকৃতিক মাধ্যমগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলস্বরূপ নদী ও ঝিরিগুলো মারা যাচ্ছে। তথ্য অনুযায়ী, শুধু বান্দরবানের থানচিতে প্রতিদিন ১০ হাজার ঘনফুট পাথর তোলা হচ্ছে। ফলে ইতিমধ্যে কয়েকশ ঝিরি মরে গেছে।

পাহাড়ি এলাকার মাটি পাথুরে হওয়ায় যেকোনো জায়গায় নলকূপ বসানো যায় না। মাটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই নলকূপ বসানোর চেষ্টা করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতি বছর এ সময় সুপেয় পানির সংকট দেখা দেয়। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর থেকে প্রতি বছর ইউপি চেয়ারম্যানসহ জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে এসব সমস্যা সমাধানে গভীর নলকূপ ও রিংওয়েল স্থাপন করা হয়। দুর্গম এলাকায় টিউবওয়েল বসালেও তেমন সুফল পাওয়া যায় না। তাই টিউবওয়েলগুলো এমন এলাকায় দেওয়া হয়েছে যেখানে পানি পাওয়া যায়। এ ছাড়া দুর্গম এলাকাতে রিংওয়েলের পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকায় চাহিদা অনুযায়ী পানির ব্যবস্থা করা যায় না। 

তবে এর মধ্যে একটা ভালো খবর হচ্ছে খাগড়াছড়িতে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫শ ফুট উঁচু গ্রামে প্রথমবারের মতো সুপেয় পানির সংকট নিরসন করছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর। এত উঁচু গ্রামে পানি সরবরাহ এটিই প্রথম। এতে সুপেয় পানি সংকটের অবসান হয়েছে। দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় পানির সংকট নিরসনের এমন প্রকল্প বাড়ানোর তাগিদ স্থানীয় বাসিন্দাদের। 

দীঘিনালা-খাগড়াছড়ি সড়কের পাশেই নয়মাইল গ্রাম। পাহাড়ের চূড়ায় অন্তত আড়াইশ পরিবারের বসবাস। শুষ্ক মৌসুম এলেই সুপেয় পানির তীব্র সংকট শুরু হয়। পাহাড়ের ঝিরি থেকে পানি সংগ্রহ করত গ্রামবাসী। এ সংকট নিরসনে একাধিকবার উদ্যোগ নিলেও পাথুরে পাহাড় হওয়ার কারণে পানির স্তর পাওয়া যায়নি। তবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের আওতায় রুরাল পাইপ ওয়াটার সাপ্লাই সিস্টেমের মাধ্যমে অবশেষে পানি পাচ্ছে গ্রামের বাসিন্দারা। 

বিশ হাজার লিটার ধারণক্ষমতার জলাধার নির্মাণ করা হয়েছে। জলাধার থেকে পাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, প্রায় ১ কোটি টাকা ব্যয়ে পানির সংকট নিরসনের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়। প্রায় ৮ কিলোমিটার এলাকায় পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হয়।

তাই পাহাড়ের এ পানি সংকট মোকাবিলায় প্রথমে প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে। পাথর উত্তোলনকারীদের থামাতে হবে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক বন যেন কোনোভাবেই ধ্বংস না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর পানি সংকটের সমাধানের জন্য বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। 




https://www.shomoyeralo.com/ad/Google-News.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড
এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫। ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com