ই-পেপার বিজ্ঞাপনের তালিকা  বুধবার ৩১ মে ২০২৩ ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
ই-পেপার  বুধবার ৩১ মে ২০২৩
https://www.shomoyeralo.com/ad/Amin Mohammad City (Online AD).jpg

https://www.shomoyeralo.com/ad/780-90.jpg
শতবর্ষ পেরিয়ে ‘বিদ্রোহী’
অরূপ তালুকদার
প্রকাশ: শুক্রবার, ২৬ মে, ২০২৩, ৫:১০ এএম | অনলাইন সংস্করণ  Count : 58

আমাদের বাংলা সাহিত্যের আকাশে ধ্রুবতারাসম এক চির বিদ্রোহী কবির নাম কাজী নজরুল ইসলাম। তার কাছ থেকেই আমরা ধারণ করেছি বিদ্রোহের মন্ত্র। তিনি আমাদের জাতীয় কবি। তার কবিতা, গান আর গল্পের মধ্য দিয়ে আমরা শিখেছি বীরত্বের অবিনাশী ভাষা।

শতবর্ষ আগে ১৯২২ সালে নজরুল রচনা করেছিলেন ১৩৯ লাইনের সেই বহুল পঠিত ও আলোচিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি। কবির এই কবিতাটি প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ‘বিজলী’ নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি। সেদিন ছিল শুক্রবার, বৃষ্টিমুখর দিন। কিন্তু আশ্চর্য ঘটনা ঘটল কবিতাটি প্রকাশের পর। ওই বৃষ্টির মধ্যেও সেদিন অতি অল্প সময়ের মধ্যে পত্রিকার প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে যায় এবং পাঠকের বিপুল চাহিদার কারণে ওই সপ্তাহেই পুনরায় আবার ওই সংখ্যার পুনর্মুদ্রণ প্রকাশিত হয়। ‘সাপ্তাহিক বিজলী’ পত্রিকায় কবিতাটি প্রথম প্রকাশের কৃতিত্ব ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামী অবিনাশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের। 

কমরেড মুজাফফর আহমেদ বলেছেন, ‘সকালে কবিতা শোনার পর আমিও বাইরে চলে যাই। তারপর বাড়িতে ফিরে আসি ১২টার কিছু পরে। আসা মাত্রই নজরুল আমাকে জানাল যে, অবিনাশদা এসেছিলেন। তিনি কবিতাটি শুনে বললেন, ‘তুমি পাগল হয়েছ নজরুল, আফজালের কাগজ কখন বার হবে তার স্থিরতা নেই, কপি করে দাও, “বিজলি”তে ছেপে দেই আগে। তাকেও নজরুল সেই পেন্সিলের লেখা হতেই কবিতাটি কপি করে দিয়েছিল।’

এরপরে আফজালুল হক সম্পাদিত ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার কার্তিক সংখ্যাতেও ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশ হয়েছিল। এর পেছনেও ছোট্ট একটু ইতিহাস আছে। কবিতাটি লেখার পরদিন সকালে কমরেড মুজাফফর আহমেদকে সেটি পড়ে শোনানোর পরে দুপুরের দিকে সেখানে আসেন আফজালুল হক। তিনি কবিতাটি শোনার পর তার সম্পাদিত ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় সেটি প্রকাশের জন্য নিয়ে গিয়ে প্রকাশ করেন। ধীরে ধীরে ভারতজুড়ে যেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আর তার সঙ্গে ‘বিদ্রোহী কবি’ নামে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন কাজী নজরুল ইসলাম। 

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বাঙালি বিদ্রোহী কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সংগীতজ্ঞ, নাট্যকার, সাংবাদিক ও সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৯৯ সালের ২৫ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে। ছোটবেলায় তার ডাকনাম ছিল দুখু মিয়া। ১৯০৮ সালে মাত্র ৯ বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। একসময় তিনি গ্রামের মসজিদের মুয়াজ্জিনও হয়েছিলেন। এসব কাজের ফাঁকে ফাঁকে অল্প বয়স থেকেই তিনি শুরু করেছিলেন লোকসংগীত রচনা। এভাবেই তার কবিজীবনের হাতেখড়ি হয়েছিল। 

তিনি জীবদ্দশায় তিন হাজারের মতো গান রচনা করেন, যার বেশিরভাগ গানেরই সুর দিয়েছিলেন তিনি নিজে। বাংলা গানের জগতে, সবার কাছে সেসব গান ‘নজরুলগীতি’ নামে সমধিক পরিচিতি পেয়েছে। 

১৯১৭ সালের শেষ দিক থেকে শুরু করে ১৯২০ সাল পর্যন্ত সৈনিক জীবনে তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক করপোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পদে উন্নীত হয়েছিলেন এবং সুনামের সঙ্গে সেই দায়িত্ব তিনি পালন করেছিলেন।

প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হলে তিনি স্বেচ্ছায় সৈনিকের পেশা ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন এবং বত্রিশ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। তখন তার সঙ্গী ছিলেন সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা এবং ওই সমিতির তৎকালীন কর্মকর্তা কমরেড মুজাফফর আহমেদ। এই সময় থেকেই তিনি পুরোপুরি সাহিত্য সাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন এবং নানা ধরনের সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন ও পরে একসময় যুক্ত হয়েছিলেন সাংবাদিকতার সঙ্গেও । 

১৯২২ সালে তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশ হওয়ার আগের বছরটিও ছিল তার জীবনের স্মরণীয় একটি বছর। ওই বছরের অক্টোবর মাসে শান্তিনিকেতনে তার সাক্ষাৎ ঘটে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। আর দ্বিতীয় যে ঘটনাটি-ওই বছরের মাঝামাঝি সময়ে তিনি কুমিল্লায় প্রমীলা দেবীর সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। 

ওই বছর তার লেখকজীবনেও আরেকটি ঘটনা ঘটে, ২৩ নভেম্বর কবির লেখা ‘যুগবাণী’ প্রবন্ধগ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত করে তৎকালীন সরকার এবং কবিকে গ্রেফতার করে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরের বছর ৭ জানুয়ারি নজরুল আত্মপক্ষ সমর্থন করে তৎকালীন প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে দৃপ্তকণ্ঠে জবানবন্দি দেন, পরবর্তী সময়ে সে জবানবন্দি ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। 

বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী অমর কবিতা ‘বিদ্রোহী’ ও এই কবিতাটি নজরুল লিখতে শুরু করেছিলেন ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের ক্রিসমাস রজনীতে। সে এক আশ্চর্য সময়, নজরুল তখন সদ্য প্রথম বিশ^যুদ্ধ ফেরত ২২ বছরের টগবগে এক রাগী যুবক। সেদিন সেই ক্রিসমাসের রাতে হঠাৎ তার মাথায় কী করে যেন এই কবিতাটি লেখার চিন্তা চলে আসে। তারপর কী ভেবে হাতের কাছে কালি-কলম না পেয়ে তুলে নেন একটি কাঠপেন্সিল এবং তা দিয়েই শুরু করেন লেখা। এভাবে ‘বিদ্রোহী’ শিরোনামের সেই কালোত্তীর্ণ অমর কবিতাটির জন্ম হয়, যা সে সময়ের রবীন্দ্র প্রভাবিত বাংলা সাহিত্যের বাইরে এক নতুন কাব্যধারার সূচনা করেছিল।

সারারাত ধরে লেখা হয় সে কবিতা। কবিতা লেখার উত্তেজনায় সারারাত প্রায় নির্ঘুম কাটে নজরুলের। সকাল হতেই কবিতাটি কাউকে দেখানোর জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। কাছাকাছি পেয়ে যান সঙ্গে থাকা বন্ধু কমরেড মুজাফফর আহমেদকে। সেই সময়ে তিনিই ছিলেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রথম শ্রোতা। 

‘বিদ্রোহী’ কবিতাটির প্রথম শ্রোতা হিসেবে তিনি তার লেখা ‘কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘তখন নজরুল আর আমি নিচের তলার পুবদিকে অর্থাৎ বাড়ির নিচের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঘরটি নিয়ে থাকি। এই ঘরেই কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি লিখেছিল।
তিনি তার ‘স্মৃতিকথা’য় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের দেখা হওয়ার বিষয়টিও বলেছেন, ‘বিদ্রোহী’ ছাপা হওয়ার পরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাৎকারের কথাও অবিনাশ চন্দ্র ভট্টাচার্য লিখেছেন এবং নজরুলের মুখে শুনেই লিখেছেন। তাতে আছে, কবিতাটি রবীন্দ্রনাথকে পড়ে শোনানোর পরে তিনি নজরুলকে বুকে চেপে ধরেছিলেন।’ 

সেই সময় স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে এমন উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া ছিল নজরুলের জীবনের এক বড় পাওয়া। কারণ অনন্যসাধারণ সাহিত্য প্রতিভা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ তখন উজ্জ্বল সূর্যের মতো মধ্য গগনে দেদীপ্যমান। রবীন্দ্র কিরণে ঝলসানো সবার মনমানসিকতা তখন যেন এক সূত্রে গাঁথা। সে সময়ের যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, মোহিতলাল মজুমদার, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মতো কবিরাও রবীন্দ্র প্রভাব অস্বীকার করতে পারেননি। 

বুদ্ধদেব বসু স্বীকার করেছেন, বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র প্রভাব এত সর্বগ্রাসী হয়েছিল, মনে হচ্ছিল, এর বাইরে যাওয়া যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না বিদ্রোহী কবিতার নিশান উড়িয়ে হই হই করে নজরুল এসে হাজির হলেন।’ 

একসময় বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব, অমিয় রবীন্দ্র বলয় থেকে বেরিয়ে এসে নিজস্ব স্বকীয়তায় প্রতিভা বিকাশে নিরন্তর সচেষ্ট থাকলেও সহজ ছিল না অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণ। শুধু জীবনানন্দই ছিলেন ব্যতিক্রম। ভিন্ন ধারার কবি, যেন আরেক জগতের মানুষ। 

সাধারণ মানুষের চোখে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তখন অনন্যসাধারণ এক দিব্যকান্তি মহিমান্বিত পুরুষ ও ফলত পরিণত হয়েছিলেন আইকনে। কিন্তু এর মধ্যে অকস্মাৎ যে বিদ্রোহী কণ্ঠটি তখন সবাইকে নাড়া দিয়ে গিয়েছিল, সে কণ্ঠটি ক্ষুধা, কষ্ট আর বিদ্রোহের প্রতীক বিদ্রোহী কবি নজরুলের। অতি দ্রুত সেই কণ্ঠটি যেন ছড়িয়ে গেল সবখানে ও সবার সুপ্ত হৃদয়কে যেন এক ঝাঁকুনিতে জাগিয়ে দিয়ে গেল। 

এই কবিতা কণ্ঠ কোনো সাধারণ মানুষের হতে পারে না ও এভাবেই নজরুল তার অসাধারণ চিন্তাভাবনা আর তেজোদীপ্ত সাহসী উচ্চারণে ধীরে ধীরে সমসাময়িককালে অনন্যসাধারণ হয়ে উঠেছিলেন। 

এখানে স্বভাবতই একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, নজরুল কেন ঠিক এই সময়, একেবারেই অন্য ধরনের এমন কবিতা লিখতে গেলেন? এই প্রশ্নের উত্তরে তাকে যারা চিনতেন, তারা বলেছেন, তার নিজের জীবনে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তো ছিলই তার সঙ্গে প্রথম মহাযুদ্ধের ভয়াবহতা মিলে অন্য এক মানুষে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিলেন নজরুল। তার মনমানসিকতায় ধ্বনিত হচ্ছিল বিদ্রোহের সুর ও তারই ফলপ্রসূ প্রকাশ এই ‘বিদ্রোহী’ কবিতা । 
বাংলা সাহিত্যে নজরুলের অমর সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখার সময় হিসাবে ইতিমধ্যে শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে। একটি কবিতা যখন তার জন্মের শতবর্ষ পূর্ণ করে কালোত্তীর্ণ হয়ে ওঠে তখন সেই কবিতা মানুষের মন থেকে কখনো মুছে যায় না, মহাকালের স্রোতেও হারিয়ে যায় না। 




https://www.shomoyeralo.com/ad/Google-News.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড
এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫। ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com