প্যাকেজের একটা বড় অংশ পরিশোধের মাধ্যমে এ বছর চূড়ান্ত নিবন্ধন করেও এজেন্সির প্রতারণার কারণে হজে যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ৪৫ জন হজযাত্রীর। তাদের কাছ থেকে প্রায় ২ কোটি টাকা নেওয়ার পরও এজেন্সির পক্ষ থেকে গোপনে আবেদন করে নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। আলোচিত আকবর হজ গ্রুপ এবং আল হেলাল এয়ার ইন্টারন্যাশনাল নিবন্ধন বাতিল করে টাকা আত্মসাতের পাঁয়তারা করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিবন্ধন বাতিলের খবর শোনার পর রংপুরের একজন মোয়াল্লিম হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। প্রতারণা শিকার হজযাত্রীদের পক্ষ থেকে নিবন্ধন বাতিল আদেশ প্রত্যাহার করে হজে পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গত সোমবার ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর কাছে আবেদন করার পর বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য মন্ত্রণালয়ের হজ শাখাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
প্রতারণার শিকার হজযাত্রীদের পক্ষ থেকে ধর্ম মন্ত্রণালয়ে করা অভিযোগে বলা হয়েছে, আল হেলাল এয়ার ইন্টারন্যাশনালের প্রতারণার কারণে ২০২২ সালে তারা হজে যেতে পারেননি। হজে পাঠাতে না পারার পরও তাদের টাকা ফেরত দেননি প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং পার্টনার এসএম হেলাল উদ্দিন ও মো. ফারুক হোসেন। পরে ২০২৩ সালে হজে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে আকবর হজ গ্রুপের আওতাধীন সাবিলুল জান্নাত এয়ার ইন্টারন্যাশনাল (লাইসেন্স নং-১১৪০) ও আল মামুন এয়ার ট্রাভেলসে (লাইসেন্স নং-৩০৯) হজযাত্রীদের ট্রান্সফার করে নিয়ে আসে। আল হেলাল কর্তৃপক্ষ তাদের নিজস্ব প্যাডে চুক্তি করে হজযাত্রীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদের মূল নিবন্ধন সম্পন্ন করে। কিন্তু নিবন্ধনের মাত্র ১০ দিন পর আকবর হজ গ্রুপের পক্ষ থেকে মো. লুতফর রহমান ফারুকী এবং এসএম হেলাল উদ্দিন নিবন্ধন বাবদ দেওয়া টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যে হজইচ্ছুদের ফোনের মাধ্যমে জানান, আপনাদের কোনো টাকা জমা হয়নি। হজে যেতে চাইলে নতুন করে প্যাকেজের পুরো টাকা দিতে হবে, তা না হলে আপনাদের নিবন্ধন বাতিল করা হবে। পরে হজইচ্ছুদের কোনো সম্মতি না নিয়ে গোপনে হজের মূল নিবন্ধন বাতিল করে এজেন্সি মালিকরা টাকা আত্মাসাতের পাঁয়তারা করছেন বলে মন্ত্রণালয়ে দেওয়া অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে বর্তমানে এ হজযাত্রীদের পবিত্র হজ পালন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, এ ঘটনার পর তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন আকবর হজ গ্রুপের মালিক মো. লুৎফর রহমান ফারুকী এবং এসএম হেলাল উদ্দিন ২০১৮ সালেও একইভাবে নিবন্ধন না করে ২ হাজার হাজির কাছ থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা আত্মাসাৎ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, যা ওই সময়ের ব্যাপক আলোচিত ঘটনা। তবে ফারুকী পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেলেও ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে ফারুকীর স্ত্রী আবাবিল ওভারসিজের মালিক তামান্না রহমানকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। তাকে ২ দিনের রিমান্ডেও পাঠিয়েছিলেন আদালত। ওই বছরের ২ মার্চ পল্টন থানায় মামলা (মামলা নম্বর-৩) হয়েছিল।
মামলার তথ্য অনুযায়ী ওই সময়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে আড়াই লাখ করে ২ হাজার হজযাত্রীর কাছ থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা নিয়ে আকবর হজ গ্রুপের চেয়ারম্যান সপরিবারে দেশের বাইরে পালিয়ে যান। পরে দেশে ফিরে আবারও বিভিন্ন এজেন্সির নামে ব্যবসা শুরু করেন। আকবর হজ গ্রুপের মালিকের পরিবারের সদস্যদের নামে একাধিক হজ এজেন্সি রয়েছে। এ ছাড়া তাদের দালাল চক্র রয়েছে, যারা অফিস খুলে হজযাত্রী সংগ্রহ করে।
অভিযোগের বিষয়ে আকবর হজ গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. লুৎফর রহমান ফারুকীর ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন কল রিসিভ করেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে এ প্রতিবেদক নিজের পরিচয় দিয়ে এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলেও কোনো জবাব দেননি। তবে আকবর হজ গ্রুপের ব্যবস্থাপক মো. হাসান ফোন করে জানান, তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা ভিত্তিহীন। কারণ যে প্রতিষ্ঠানকে অভিযোগকারী হজযাত্রীরা টাকা দিয়েছেন সেগুলোর সঙ্গে আকবর হজ গ্রুপের কোনো সম্পর্ক নেই। তাই তাদের পক্ষ থেকে কোনো হজযাত্রীর নিবন্ধন বাতিল করা হয়নি।
এ বিষয়ে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক জানান, অভিযোগ পাওয়ার পর বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সচিবকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোনো এজেন্সি প্রতারণা করে থাকলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ বিষয়ে জানান, তাদের কাছে অভিযোগ আসার পর বুধবার অভিযুক্ত হজ এজেন্সিকে মন্ত্রণালয় থেকে ফোনে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে হজযাত্রীরা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। অভিযোগকারীদের সঙ্গে বসে দ্রুত বিষয়টি মীমাংসা না করলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, এ বছর চূড়ান্ত নিবন্ধন করেও হজে যাওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন প্রায় ৪ হাজার ২০০ হজযাত্রী। এর মধ্যে নিবন্ধন রিপ্লেস করেছেন (একজনের পরিবর্তে অন্যজন যাওয়া) ৩ হাজার ২১০ জন। এ ছাড়া ৯৭০ জন নিবন্ধন বাতিল করেছেন বলে ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে। যারা নিবন্ধন বাতিল করেছেন তারা নিবন্ধনের অল্পকিছু টাকা কাটার পর বাকি টাকা ফেরত পাবেন।
চলতি বছর হজের খরচ অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় ৯ দফা সময় বাড়িয়েও নির্ধারিত কোটা পূরণ করতে পারেনি সরকার। বারবার সময় বাড়ানোর পরও ফাঁকা থাকা প্রায় ৫ হাজার কোটা সৌদি সরকারকে ইতিমধ্যে ফেরত দিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। হজ অনুবিভাগের কর্মকর্তারা জানান, চূড়ান্ত নিবন্ধন করেও শেষ মুহূর্তে এসে নিবন্ধন বাতিল করেছেন ৯৭০ জন। এর মধ্যে সরকারি কোটার ১৫১ জন এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনার ৮১৯ জন। এসব হজযাত্রীর টাকা এখন ফেরত দেওয়া হবে। তাদের নাম বাতিল করে চূড়ান্ত তালিকা ইতিমধ্যে সৌদি সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে।