দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র ও বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ ঘোষিত হালদা নদীতে এ পর্যন্ত তিন দফা নমুনা ডিম ছেড়েছে রুই বা কার্পজাতীয় মা মাছ। আসন্ন অমাবস্যার জোতে পুরোপুরি ডিম ছাড়ার অপেক্ষায় রয়েছেন জেলেরা। তবে এই ডিম সংরক্ষণ ও রেণু ফোটানো নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা। জেলেদের অভিযোগ, সরকারি হ্যাচারিগুলোতে চরম অব্যবস্থাপনার কারণে প্রতি বছরই সংগ্রহকৃত মা মাছের ডিম ও রেণু নষ্ট হয় বিপুল পরিমাণে। এর মূল্য কোটি কোটি টাকা। এর জন্য দায়ী সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্তাব্যক্তিদের গাফিলতি।
জেলেরা জানান, প্রতি বছরের মতো এবারও হালদা নদী থেকে রুই বা কার্প জাতীয় মাছের ডিম সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত হালদা পারের সহস্রাধিক জেলে। কিন্তু এই ডিমের রেণু ফোটানোর জন্য মৎস্য অধিদফতরের অধীনে হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলায় ৪টি করে মোট ৮টি সরকারি হ্যাচারি রয়েছে। এটি প্রয়োজনের তুলনায় কম। এর মধ্যে বর্তমানে রাউজান উপজেলার মোবারকখিল এলাকার হ্যাচারিটি চালু থাকলেও সিপাহিরঘাট নিউ হ্যাচারি, মঘাশাস্ত্রি ও কাগতিয়া স্লুইস গেট হ্যাচারি অকেজো। অন্যদিকে হাটহাজারীর ৪টি হ্যাচারির মধ্যে গড়দুয়ারা হ্যাচারি হালদার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। বড়–য়াপাড়া, শাহমাদারী ও মাছুয়াঘোনা হ্যাচারি চালু আছে। পাশাপাশি হালদার মৎস্য সম্পদ উন্নয়ন কাজে থাকা এনজিও সংস্থা আইডিএফ হালদা প্রকল্পের আওতায় রাউজানের গড়দুয়ারা অংশের সিপাহিঘাট এলাকায় একটি হ্যাচারি আছে। সরকারি হ্যাচারিগুলোর তুলনায় এই হ্যাচারিটি বেশ পরিপাটি, ব্যবস্থাপনাও সন্তোষজনক।
প্রতি বছর প্রায় ৩০ জন ডিম সংগ্রহকারী এই হ্যাচারিতে ডিম ফোটানোর সুবিধা পেয়ে থাকেন। প্রায় দেড়শ কেজি ডিম থেকে রেণু ফোটানোর ব্যবস্থা আছে এই হ্যাচারিতে। ওই হ্যাচারিতে প্রতিবার ডিম ফোটাতে চৌবাচ্চাপ্রতি ১ হাজার টাকা করে দিতে হয় আইডিএফকে। অন্যদিকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হ্যাচারিগুলোতে বিনামূল্যে ডিম ফোটানোর কথা থাকলেও সেখানেও চৌবাচ্চাপ্রতি ১ হাজার টাকা করে দিতে হয় জেলেদের। এসব হ্যাচারির বেহাল দশার কারণে হালদা থেকে বেশিরভাগ জেলেই প্রাচীন পদ্ধতিতে নদীর পাড়ে মাটির কুয়া তৈরি করে তাতে ডিম সংরক্ষণ করে রেণু ফোটান। আর এ পদ্ধতিতে জেলেরা কুয়ায় নদীর ঘোলা পানিতে ডিম সংরক্ষণ করেন। রেণু ফোটার পরে চার দিন এই রেণুগুলোকে এক কুয়া থেকে অন্য কুয়াতে সুতি কাপড়ে নদীর পানি দিয়ে স্থানান্তর করা হয়। স্থানান্তরের সময় অনেক রেণু মারা যায়। রাউজান-হাটহাজারী উপজেলার হালদা পারে বর্তমানে প্রায় ৬০টি মাটির কুয়া আছে।
হালদা নদী ঘিরে হ্যাচারির অব্যবস্থাপনার কথা উল্লেখ করে হালদা গবেষক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলী আজাদী বলেন, হালদা নদী থেকে প্রতি বছর এক থেকে দেড় হাজার কেজি পর্যন্ত কার্পজাতীয় মা মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ হয়। এসব ডিম থেকে ফোটানো প্রতি কেজি রেণুর দাম প্রায় ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এক কেজি ডিম থেকে আনুমানিক আড়াই থেকে তিন কেজি পর্যন্ত রেণু হয়ে থাকে। সেই হিসেবে এই ডিম থেকে শতকোটি টাকার সম্পদ আহরণ করা হয়। এর মধ্যে কোটি কোটি টাকার রেণু ফোটানোর পর যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে মারা যায়, যা দেশের অর্থনীতির জন্য বড় ক্ষতি। এই ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া রেণু ফোটানো জেলেদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, একটা হ্যাচারি সঠিকভাবে পরিচালনা করতে বেশ কিছু বিষয়ে নজর দিতে হয়। যেমন চৌবাচ্চাতে ডিম রাখার পর যে পানি দেওয়া তা অবশ্যই পুকুরের পরিষ্কার পানি হতে হবে। কিন্তু আমার জানা মতে মদুনাঘাট হ্যাচারি ছাড়া বাকি হ্যাচারিগুলোর একটিতেও পুকুর নেই। নদীর ঘোলা ও অপরিষ্কার পানি চৌবাচ্চাতে দেওয়া হয়। এর কারণে বেশিরভাগ ডিমই নষ্ট হয়ে যায়। অথচ ডিম সংগ্রহ ও সংরক্ষণে প্রতিটি হ্যাচারিতে পুকুর থাকা দরকার। তিনি বলেন, বছরের অন্যান্য সময় হ্যাচারিগুলো থাকে অযতœ-অবহেলায়। এসব দেখভালের জন্য কোনো লোকই থাকে না। শুধু প্রজনন মৌসুমে কিছুটা পরিষ্কার করা হয়। কিন্তু এতে ডিম ফোটার পরিবেশ তৈরি হয় না। এককথায় মদুনাঘাট হ্যাচারি ছাড়া বাকি একটা হ্যাচারিও গুণগত মানের না। মৎস্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত। নজরদারির পাশাপাশি জেলেদের সচেতনতা ও দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করতে হবে।
হালদা নদীতে প্রায় ৩৫ বছর ধরে ডিম সংগ্রহ করে আসছেন হালদা পারের বাসিন্দা কামাল সওদাগর। তার মতে, ডিম সংগ্রহ থেকে সংরক্ষণ পর্যন্ত ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডিম নষ্ট হয় ডিম থেকে রেণু ফোটার উদ্দেশ্যে সংরক্ষণের সময়। এ ক্ষেত্রে তিনি সরকারি হ্যাচারির বহুমুখী অব্যবস্থাপনাকেই দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, প্রয়োজনের তুলনায় সরকারি হ্যাচারির সংখ্যা খুবই কম। তা ছাড়া সরকারি হ্যাচারি বেশিরভাগ সময়ই থাকে অপরিচ্ছন্ন ও ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি। এ কারণে মাছের ডিম রেণুতে পরিণত হওয়ার আগেই কিছু কিছু সরকারি হ্যাচারিতে মারা যায়। অতীতে এ কারণে অনেক ডিম সংগ্রহকারী জেলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ডিম সংগ্রাহক কামাল বলেন, আধুনিক পদ্ধতিতে হ্যাচারিতে ডিম ফোটালে ভালো ফল পাওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। হ্যাচারিতে ডিম ফুটে বের হওয়া পোনা বেশ দুর্বল হয়, ফলে পুকুরে ছাড়লে তার বেশিরভাগই মারা যায়। কিন্তু মাটির কুয়াতে সংরক্ষণ করা ডিম থেকে প্রায় ৬০ শতাংশ পোনা পাওয়া যায়। তবে সেসব পোনা দ্রুত বর্ধনশীল ও শারীরিক গঠন ভালো হয়। অন্যদিকে কৃত্রিম কুয়ার পোনার বৃদ্ধি অনেক কম। তাই এবারও ডিম সংগ্রহ করার প্রস্তুতিতে থাকা বেশিরভাগ জেলেই মাটির কুয়া তৈরি ও আগের কুয়া সংস্কার করেছেন।
হ্যাচারির অব্যবস্থাপনার বিষয়ে জানতে চাইলে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহিদুল আলম বলেন, হ্যাচারি রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব মৎস্য বিভাগের। তবে গত বছর থেকে সরকারি হ্যাচারিগুলো দেখাশোনার দায়িত্ব আমাদের দেওয়া হয়েছে। তারপর আমি নিজে জেলে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, সাবমার্সিবল পাম্প বসানো, চৌবাচ্চা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করাসহ হ্যাচারিকে ব্যবহার উপযোগী করতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিয়েছি। এ কারণে জেলেরা অন্য বারের তুলনায় এবার পোনার সংগ্রহ ও সংরক্ষণে বেশি সুফল পাবেন।
হ্যাচারির অব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী বলেন, সরকারি হ্যাচারিতে ডিম ফোটার সাফল্যের হার বেশি হওয়ায় প্রায় সবাই এখানে ডিম ফোটাতে চায়। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হওয়ায় সবাইকে আমরা হ্যাচারি ব্যবহারের সুযোগ দিতে পারি না। আগে থেকেই আগ্রহীদের নিয়ম অনুসরণ করে বরাদ্দ দিতে হয়। তারপরও এমন অভিযোগ এলে কী করার আছে বলুন। আমি মনে করি, যারা এসব অভিযোগ করছে তাদের সরকারি হ্যাচারি ব্যবহারের প্রয়োজন নেই।