
ঘড়িতে সময় ১০টা বেজে ১৭ মিনিটি। বেলা ১১টায় আধা ঘণ্টার দূরত্বের এক হাইটেক কোম্পানিতে আপনার বিগ বাজেট প্রজেক্ট প্রেজেন্টেশন। হাতে সময় নেই, কোনো এক কারণে তৈরি করা হয়নি প্রেজেন্টেশন ফাইল। স্যুটেড-বুটেড হয়ে ১০টা ২৫ মিনিটে ঘর থেকে বের হয়ে দেখলেন গ্যারেজ থেকে আপনার অটোনোমাস গাড়িটি বের হয়ে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। গাড়ির সামনে আসতেই ইঞ্জিন চালু হয়ে দরজা খুলে গেল। আপনি ব্যাকসিটে চেপে কিছু বলার আগেই গাড়ি ছুটেছে আপনার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। প্রেজেন্টেশন ফাইল তৈরির উদ্দেশ্যে ল্যাপটপ অন করতেই মিনিটখানেক সময় ধরে ক্রমাগত কিছু ট্যাব খুলল এবং বন্ধ হয়ে গেল। দেখলেন প্রজেক্টের জন্য নির্দিষ্ট প্রেজেন্টেশন ফাইল তৈরি হয়ে গেছে। প্রেজেন্টেশন ফাইল চেক করতে করতে দেখলেন নির্দিষ্ট সময়ের আগেই পৌঁছলেন গন্তব্যস্থলে।আপনার অটোনোমাস ড্রাইভিং সিস্টেম সংবলিত গাড়ি সব থেকে যানজট কম থাকা রাস্তা খুঁজে নিয়ে আপনাকে পৌঁছে দিয়েছে। ভাবছেন, কোনো প্রকার কমান্ড ছাড়া এত কাজ একসঙ্গে হলো কীভাবে? কাজগুলো সম্ভব হয়েছে নিউরোলিংক এবং আপনার আয়ত্তে থাকা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তির সাহায্যে।
নিউরোলিংক এক প্রকার ‘ব্রেইন-মেশিন ইন্টারফেস’ ডিভাইস, যা প্রসেসিং চিপ এবং ছোট ইলেক্ট্রোডের সমন্বয়ে তৈরি। নমনীয় এবং জৈব উপাদান দিয়ে তৈরি এই ডিভাইসটি জুড়ে দেওয়া হয় ব্যবহারকারীর মস্তিষ্কের সঙ্গে। মস্তিষ্কের নিউরনে তৈরি হওয়া ‘স্পাইক/অ্যাকশন পটেনশিয়াল’ বা বৈদ্যুতিক তরঙ্গ শনাক্ত করতে পারে নিউরোলিংকের ইলেক্ট্রোড। আর প্রসেসিং চিপের সাহায্যে মস্তিষ্কের তরঙ্গকে পাঠানো হয় শরীরের সঙ্গে থাকা বাহ্যিক ডিভাইসে। মস্তিষ্কের নিউরনে সৃষ্টি হওয়া বৈদ্যুতিক তরঙ্গ লিপিবিদ্ধ করে বাহ্যিক ডিভাইসটি সেই তরঙ্গকে কমান্ডে রূপ দিয়ে সেটি অনুযায়ী স্মার্ট ডিভাইসগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। এভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে যেকোনো স্মার্টফোন, সাধারণ কম্পিটার, রোবটিক আর্ম এবং প্রোগ্রামিং কমান্ড মেনে চলে এমন কোনো ডিভাইস।
লিডস বেকেট ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সিনিয়র লেকচারার ড. রোজ ওয়াট-মিলিংটনের মতে, এই প্রযুক্তির সাহায্যে আমাদের ব্যবহৃত ডিভাইসগুলো সরাসরি সংযুক্ত করতে পারব আমাদের মস্তিষ্কের সঙ্গে। ব্লুটুথ বা ওয়্যারলেস ডিভাইসগুলো যেভাবে কাজ করে, ঠিক সেভাবে কাজ করবে। হাত ব্যবহার না করেই আমাদের চিন্তায় আসা কমান্ডগুলোই নির্দেশনা হিসেবে কাজ করবে কম্পিউটার এবং স্মার্ট ডিভাইসগুলো নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে। নিউরোলিংক প্রতিষ্ঠান এই প্রযুক্তি নিয়ে বেশ কিছু সময় ধরেই কাজ করছে। ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা ছাড়া এখনও বলা সম্ভব নয় এই নিউরোলিংক প্রযুক্তি আসলেও মানবদেহে ব্যবহারের জন্য কতটা নিরাপদ। তা ছাড়া প্রযুক্তিটি মানুষের মস্তিষ্কে স্থাপন করে ব্যবহারযোগ্য হলেও, মস্তিষ্কে এই চিপ শতভাগ শুদ্ধভাবে বসানোর প্রক্রিয়া হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
নিউরোলিংক ডিভাইস নিয়ে কাজ শুরু হলেও এখন পর্যন্ত তা পুরোপুরি পূর্ণতা পায়নি। টেসলার সিইও ইলন মাস্ক কো-ফাউন্ডার হিসেবে যোগ দেওয়ার পর এই প্রযুক্তির গবেষণা ও বিকাশে ২০১৬ সালে শুরু হয় ‘নিউরোলিংক’ নামের প্রতিষ্ঠানের যাত্রা। এখন পর্যন্ত নিউরোলিংক ডিভাইসটি বাণিজ্যিকভাবে বাজারে না এলেও ল্যাব পরীক্ষায় সফল হয়েছে। বানর, ভেড়া ও শূকরের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে এসেছে এই সফলতা। প্রতিষ্ঠানটির প্রকাশ করা এক ভিডিওতে সফলভাবে চিপ স্থাপন করা এক বানরকে নিউরোলিংক প্রযুক্তি ব্যবহার করে গেম খেলতে দেখা যায়।
তবে সরেজমিন তথ্য সংগ্রহ এবং প্রতিষ্ঠানটির কিছু গোপন সূত্রের বরাতে বার্তা সংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে জানায়, পরীক্ষার জন্য ব্যবহার করা প্রাণীগুলোর মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৫০০ প্রাণী মারা গেছে। কিছু প্রাণীকে হত্যা করা হয়েছে গবেষণার অংশ হিসেবে এবং কিছু প্রাণী পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই মারা গেছে। এমনকি ব্যবহৃত প্রাণীদের কোনো যথাযথ নথি বা হিসাব রাখেনি নিউরোলিংক। প্রযুক্তিটি বাজারজাত করার উদ্দেশ্যে ইলন মাস্ক কাজের গতি বাড়াতে চাপ দেওয়ায় এমন ঘটনা ঘটেছে বলে সূত্রের বরাতে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
গেল বছর ডিসেম্বরে এক টুইটে ইলন মাস্ক জানান, ‘আমি আত্মবিশ্বাসী, নিউরোলিংক মানুষের ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হয়েছে। এখন শুধু অনুমোদন প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার অপেক্ষায়।’ এরপর ২৬ মে ব্রেইন-চিপ ফার্ম নিউরোলিংকের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, প্রথমবারের মতো মানুষের ওপর পরীক্ষা চালানোর জন্য ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) থেকে অনুমোদন পেয়েছে তারা। কিন্তু এখনই তারা মানব স্বেচ্ছাসেবকদের ওপরে পরীক্ষা শুরু করবে না। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি মাস্ক। যদিও অনুমোদনের ঘটনার আগে, নিউরোলিংক ব্যবহার করে দৃষ্টি এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষের দৃষ্টি ফেরাতে এবং চলাচলে সক্ষম করে তুলতে চান বলে জানিয়েছিলেন ইলন মাস্ক।
মাস্কের নিউরোলিংক অবশ্য এ ক্ষেত্রে একমাত্র সফলতা নয়। ১২ বছর আগে সাইকেল চালাতে গিয়ে এক দুর্ঘটনার মুখে পড়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন ৪০ বছর বয়সি ডাচ যুবক গের্ট জান ওস্কাম। কোমর থেকে পা পর্যন্ত অবশ হয়ে যাওয়ায় হুইল চেয়ারই ছিল তার শেষ ভরসা। কিন্তু সুইস গবেষকদের উদ্ভাবিত অনেকটা নিউরোলিংকের মতো ‘ইলেক্ট্রনিক ব্রেইন ইমপ্ল্যান্ট’-এর সাহায্যে সম্প্রতি হাঁটতে সক্ষম হয়েছেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত এই যুবক। গের্টের মস্তিষ্কে বসানো ইলেক্ট্রনিক ইমপ্ল্যান্ট, তার মেরুদণ্ডে স্থাপন করা অপর ইলেক্ট্রনিক ইমপ্ল্যান্টকে সংকেত পাঠায় আর সে অনুযায়ী কাজ করছে তার পায়ের স্নায়ু ব্যবস্থা। গের্ট এখন হাঁটতে কিংবা সিঁড়ি বেঁয়ে উঠতে পারলেও গবেষকরা বলছেন, পুরোপুরি সুস্থতার জন্য তাকে আরও কিছু পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
নিউরোলিংক প্রযুক্তির সাফল্য পক্ষাঘাতগ্রস্ত লোকদের সমস্যা নিরাময় করতে পারলেও এই প্রযুক্তির প্রভাব হবে আরও বিস্তৃত। এই প্রযুক্তির সাহায্যে একজন দক্ষ এবং সুস্থ মানুষকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সঙ্গে জুড়ে দিলে সেটির প্রভাব হবে অভাবনীয়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং নিউরোলিংকের সমন্বয়ে মানুষ খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে যেকোনো সুপার কম্পিউটার, বিশাল কোনো ‘রোবটিক ফোর্স’ কিংবা স্যাটেলাইট কন্ট্রোলের মতো কাজ। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, নিউরোলিংক এবং মানুষের সমন্বয়েই হয়তো তৈরি হতে পারে ভবিষ্যতের আর্টিফিশিয়াল স্ট্রং ইন্টেলিজেন্স।