পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থিত কাবা গৃহ বিশ্ব মুসলিমের কেবলা ও প্রাণকেন্দ্র। বিশ্বের অগণন মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন। কাবাঘরকে কেন্দ্র করেই ইসলামের একটি মৌলিক ও বুনিয়াদি বিধান হজের সূচনা হয়।
কাবার আকর্ষণে লাখো-কোটি মানুষের সমাগম ঘটে মক্কা নগরীতে। রবের চূড়ান্ত সান্নিধ্য অর্জনের আশায় আল্লাহপ্রেমী বান্দারা কাবার ছায়াতলে সমবেত হয়। ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ ধ্বনিতে মুখরিত করে তুলে পুরো চত্বর। কাবা মুনিব আর গোলামের মধ্যবর্তী সেতুবন্ধ। মুমিন বান্দারা কাবার সংস্পর্শ পেলে হৃদয়ে অনাবিল প্রশান্তি অনুভব করেন। পবিত্র আঙিনায় সেজদাবনত হয়ে হৃদয়ের আবেগ, অনুভূতি ও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন এবং মশগুল হন প্রভুর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায়।
পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর
পৃথিবীর প্রথম ঘর পবিত্র কাবা। আদি পিতা আদম (আ.) জান্নাত থেকে পৃথিবীতে আগমনের পর সর্বপ্রথম এ ঘর নির্মাণ করা হয়। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর, যাকে মানুষের কল্যাণের জন্য বানানো হয়েছে, তা হলো মক্কায় অবস্থিত (কাবা)’ (সুরা আলে ইমরান : ৯৭)। মুফাসসিরীনে কেরাম এই আয়াতের দুটি ব্যাখ্যা করেছেন। এক. সর্বপ্রথম ঘর বলতে সর্বপ্রথম উপাসনালয়। অর্থাৎ পৃথিবীর ইতিহাসে কাবাগৃহই সর্বপ্রথম উপাসনালয়। এর আগে পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনো উপাসনালয় নির্মিত হয়নি। দুই. সর্বপ্রথম ঘর বলতে সর্বপ্রথম বাসগৃহ। অর্থাৎ পৃথিবীর ইতিহাসে কাবাগৃহই সর্বপ্রথম ঘর। এর আগে পৃথিবী নামক গ্রহে কোনো ঘর নির্মাণ হয়নি। এটা আশ্চর্যের কিছু নয়-হজরত আদম (আ.) পৃথিবীতে পদার্পণ করার পর নিজের বাসগৃহ নির্মাণ করার আগেই ইবাদতখানা নির্মাণ করে থাকবেন।
বরকত ও কল্যাণের উৎস
আসমান থেকে বরকতের ধারা পবিত্র কাবার ওপর অবতীর্ণ হয়। তারপর সারা বিশ্বে তা ছড়িয়ে পড়ে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্ধারিত হয়েছে, সেটাই হচ্ছে এ ঘর, যা বাক্কায় অবস্থিত এবং সারা জাহানের মানুষের জন্য হেদায়েত ও বরকতের আধার’ (সুরা আলে-ইমরান : ৯৬)। কোনো জিনিসের বরকত দুভাবে হয়-এক. বাহ্যিকভাবে। দুই. অভ্যন্তরীণভাবে। কাবা শরিফের বাহ্যিক বরকত তো এই-আল্লাহ তায়ালা এর উসিলায় মক্কায় সব ধরনের খাবার, ফলমূল ও শস্যের ব্যবস্থা করেছেন। সিজন ও মৌসুম ছাড়াও সব ধরনের ফলমূল সবসময় পাওয়া যায়। কোনো সময় খাবারের সংকট দেখা যায় না সেখানে। বিশেষত হজের মৌসুমে; যখন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হজব্রত পালনের জন্য মানুষ মক্কা-মদিনায় সমবেত হয়। এর কারণে কখনো শোনা যায়নি, মক্কা-মদিনায় খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। আর কাবা শরিফের অভ্যন্তরীণ বরকত এই, ‘মসজিুল হারামে আদায়কৃত নামাজের প্রতি রাকাতের বিনিময়ে এক লাখ রাকাতের সওয়াব পাওয়া যায়।’ (ইবনে মাজা : ১২৪৩)
বিশ্ববাসীর পথপ্রদর্শক
ভূতত্ত্ববিদগণ বলেন, কাবা শরিফ সারা পৃথিবীর মধ্যখানে অবস্থিত। একটি গৃহের মধ্যভাগে যদি মোমবাতি প্রজ্বালন করা হয়, তা হলে যেমন পুরা ঘরের চতুর্দিকে আলো সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তদ্রূপ আল্লাহ তায়ালা কাবা শরিফ থেকে হেদায়েতের নূর পৃথিবীর দিগন্তজুড়ে বিকিরণ করে দেন।
মাকামে ইবরাহিম
কাবার সীমানায় প্রভুর শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন এটি। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘এতে রয়েছে মাকামে ইবরাহিমের মতো প্রকৃষ্ট নিদর্শন’ (সুরা আলে-ইমরান : ৯৭)। মাকামে ইবরাহিম মূলত ওই পাথর, যার ওপর আরোহণ করে ইবরাহিম (আ.) কাবা শরিফ নির্মাণ করেছিলেন। পাথরটি নির্মাণের উচ্চতার সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওপরে উঠে যেত। আবার নিচে নামার প্রয়োজন হলে নিচে নেমে যেত। একটি নির্জীব, নিষ্প্রাণ, নিষ্প্রভ জড়পদার্থের পক্ষে প্রয়োজন বশত উঁচু-নিচু হওয়া প্রভুর কুদরতেরই প্রমাণ বহন করে। এটি প্রাথমিক অবস্থায় কাবা শরিফের নিচে ছিল, যখন মাকামে ইবরাহিমের পাশে নামাজের নির্দেশনা এলো, তখন পাথরটিকে কাবা শরিফের অদূরেই রাখা হয়। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর তোমরা ইবরাহিমের দাঁড়ানোর জায়গাকে নামাজের জায়গা বানাও’ (সুরা বাকারা : ১২৫)। বর্তমানে এটি গ্লাস দ্বারা পরিবেষ্টিত ও সংরক্ষিত একটি পাথর। তাওয়াফের পর মাকামে ইবরাহিমে দুই রাকাত নামাজ পড়া ওয়াজিব।
কাবার সীমানায় প্রবেশকারীরা নিরাপদ
মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আর যে লোক এর ভেতরে প্রবেশ করবে, সে নিরাপত্তা লাভ করবে’ (সুরা আলে-ইমরান : ৯৭)। কাবার উসিলায় কাবার সীমানায় প্রবেশকারীরা সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ ও নিরাপত্তায় পরিবেষ্টিত হয়ে যান। সব ধরনের আক্রমণ থেকে হেরেমের অধিবাসীরা নিরাপত্তা লাভ করে থাকেন। জাহেলিয়াতের যুগের আরবরা ঈমানদার ছিল না বটে কিন্তু তাদের হৃদয়ে কাবার মাহাত্ম্য এত পরিমাণ ছিল-কাবার সীমানায় প্রাণের শত্রু, মা-বাবার হত্যাকারীকে কাছে পেলেও আক্রমণ তো দূরের কথা, কোনো ধরনের কটূক্তিও করত না। চোখে-মুখেও আক্রমণের অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শিত হতো না।
বিশ্ব-মুসলিমের সম্মিলনস্থল
হজকে উপলক্ষ করে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে লাখো-কোটি মানুষ সমবেত হন এবং তাওয়াফ, জিয়ারতে বায়তুল্লাহ, আরাফা, মিনা, মুজদালিফায় অবস্থানসহ হজের সব বিধান একসঙ্গে সুসম্পন্ন করেন। যেখানে থাকে না কোনো ধনী-গরিবের ভেদাভেদ, রাজা-প্রজার পার্থক্য, আমির-ফকিরের ব্যবধান। মুসলমানদের সর্ববৃহৎ এই সম্মিলন থেকে পারস্পরিক ভালোবাসা, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য সৃষ্টি হয়। কাঁধে কাঁধ মিলে একতাবদ্ধ হয়ে দ্বীনের কাজ করার অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হয়। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আর আমি কাবা গৃহকে মানুষের জন্য সম্মিলনস্থল ও শান্তির আলোয় করেছি।’ (সুরা বাকারা : ১২৫)
বিশ্বের স্থিতিশীলতা ও শান্তির প্রতীক
সারা পৃথিবীর ব্যবস্থাপনা স্বরূপে বহাল থাকা ও সুপ্রতিষ্ঠিত থাকা পবিত্র কাবার সম্মান বহাল থাকার ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ যতদিন কাবার দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করা হবে এবং হজ পালিত হতে থাকবে, ততদিন এ গ্রহ ও জগৎ সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে। যদি কোনো দিন বায়তুল্লাহর সম্মান বিলুপ্ত হয়ে যায়, বায়তুল্লাহর দিকে মুখ করে নামাজ পড়া ছেড়ে দেওয়া হয়, হজ আদায় ছেড়ে দেওয়া হয়-তবে পৃথিবীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। বিনাশ হয়ে যাবে পৃথিবীর সব ব্যবস্থাপনা ও স্থিতিশীলতা। আর এর ইঙ্গিত পাই পবিত্র কুরআন থেকে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তায়ালা সম্মানিত গৃহ কাবাকে মানুষের স্থিতিশীলতার কারণ বানিয়েছেন’ (সুরা মায়েদা : ৯৮)। আল্লাহ সবাইকে পবিত্র এ গৃহের মর্যাদা অনুধাবনের ও হজের তওফিক দিন।