ঘরে-বাইরে সব জায়গায় এখন আলোচনার অন্যতম বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে চলমান তাবদাহ। বিগত কয়েক বছরে চরম ভাবাপন্ন হয়ে উঠছে দেশের জলবায়ু। দিনে দিনে অবস্থা অসহনীয় হয়ে উঠছে আরও। আর এর সবকিছুর মূলে সবচেয়ে বড় যে কারণ তা হচ্ছে উত্তরোত্তর নগরায়ণের দিকে ঝুঁঁকতে গিয়ে নির্বিচারে বন উজাড়। শহর তো শহর, গ্রামগঞ্জেও উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে গরমের দিনে গরম আর শীতের দিনে ঠান্ডার তীব্রতা। প্রকৃতি যেন প্রতিশোধ নিচ্ছে তার ওপর মানুষের নিপীড়নের। এরপরও সচেতন হয় না মানুষ, বিশেষ করে চোরাই কাঠের ব্যবসায়ীরা। দিনের পর দিন তাদের কড়ালগ্রাসে উজাড় হয়ে যাচ্ছে একের পর এক বন। এমনই উদ্বেগজনক দৃশ্য চোখে পড়ছে টাঙ্গাইলের শালবনে। দেশের অন্যতম বৈশিষ্ট্যম-িত এ বনাঞ্চল ঘিরে ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠেছে বেশ বড় একটি প্রভাবশালী চক্র, যাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে কিছু অসাধু বনরক্ষা কর্মকর্তাও। কর্মকর্তাদের নাকের ডগায় বসেই দিনে-রাতে সমানে গাছ কেটে বনাঞ্চল সাফ করে দিচ্ছে চক্রটি।
টাঙ্গাইলের সখীপুর বন বিভাগের তিনটি রেঞ্জের আওতাধীন এলাকায় দাঁড়িয়ে আছে ৪২টি করাতকল। ১১টি বিট কার্যালয়ের অবস্থান এখানে। অথচ সংরক্ষিত শাল-গজারি ও সামাজিক বনায়নের ভেতর, বনঘেঁষে, এমনকি বন কর্মকর্তাদের কার্যালয়ের কাছেই কলগুলো স্থাপন করা হয়েছে। করাতকলগুলো উচ্ছেদের দাবি জানিয়ে লিখিত অভিযোগও দেওয়া হয়েছে টাঙ্গাইল বিভাগীয় বন কর্মকর্তার (ডিএফও) কাছে। তাতেও মিলছে না কোনো সমাধান। দিন-রাত কর্তৃপক্ষের চোখের সামনেই কাটা হচ্ছে বনাঞ্চলের গাছ।
স্থানীয় বন বিভাগের তালিকা থেকে জানা যায়, ৪২টি অবৈধ করাতকলের মধ্যে বহেড়াতৈল রেঞ্জে ২৮টি, হাতিয়ায় ৭টি ও বাঁশতৈল রেঞ্জে সাতটি করাতকল বর্তমানে চালু রয়েছে। আর বৈধ করাতকল মালিকদের দাবি, প্রতিটি অবৈধ করাতকলে প্রতিদিন কমপক্ষে ২০০ ঘনফুট কাঠ চেরাই হচ্ছে। সে হিসাবে প্রতিদিন ৮ হাজার ৪০০ ঘনফুট, মাসে দুই লাখ ৫২ হাজার ও এক বছরে ৩০ লাখ ২৪ হাজার ঘনফুট বনের কাঠ চেরাই হচ্ছে ওই ৪২টি অবৈধ করাতকলে। এভাবে প্রতিনিয়ত সংরক্ষিত বনের গাছ চেরাই হলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
সরেজমিন বহেড়াতৈল রেঞ্জের কাঁকড়াজান বিট কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ওই বিটের আনুমানিক ১০০ গজ পশ্চিমে জয়নাল আবেদিন নামে এক ব্যক্তি ও উত্তর পাশে সমপরিমাণ দূরত্বে নূর জামাল নামে আরেক ব্যক্তি দুটি করাতকল স্থাপন করেছেন। অথচ বন আইনে করাতকল স্থাপন নিয়ে ৭-এর ক ধারা মোতাবেক সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে করাতকল স্থাপনের কোনো বিধান নেই।
এরই মধ্যে একটি করাত কলে কাঠ চেরানো দৃশ্যের ছবি তুলতে গেলে পেছন দিক থেকে এসে বাধা দেন কলটির মালিক নূর জামাল। এ সময় তিনি বলেন, ‘বন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই আমরা এসব করাতকল চালাই। ছবি তুলে আপনি কী করবেন?’ পরে বন কার্যালয়ের পাশে করাতকল কীভাবে চলছে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি কাঁকড়াজান বিট কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম।
কাঁকড়াজান বিটের আওতাধীন বড় হামিদপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পেছনে স্থানীয় আনসার আলী নামের এক ব্যক্তি করাতকল স্থাপন করেছেন। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল হাশেম বলেন, ‘বিদ্যালয় চলাকালীন করাতকলের শব্দে শিশুশিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় বিঘœ ঘটে। এ ছাড়াও কাঠের গুঁড়ো শিশুদের চোখে এসে পড়ে। প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের কিছু বলা যায় না।’
বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বহেড়াতৈল রেঞ্জ কর্মকর্তা আমিনুর রহমান বলেন, ‘আমরা মাঝেমধ্যেই অবৈধ করাত কলগুলো উচ্ছেদে অভিযান চালাই। বেশ কয়েক মালিকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও করেছি। উচ্ছেদ করার এক সপ্তাহ পরেই আবার তারা সেখানেই কল স্থাপন করে। আমাদের ম্যানেজ তো দূরের কথা, আমাদের তোয়াক্কাও করে না তারা।’
আর উপজেলার হাতিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা আবদুল আহাদ বলেন, ‘আমি এই রেঞ্জে যোগদান করার পর কমপক্ষে ২৫টি করাত কল উচ্ছেদ করেছি। এখন মাত্র ৬-৭টি করাতকল রয়েছে। এগুলোও উচ্ছেদ করা হবে।’
এদিকে সখীপুর পৌরসভার বৈধ করাতকল মালিক সমিতির সভাপতি আলহাজ জিন্নত আলী ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক বলেন, ‘বনাঞ্চলে অবৈধ করাতকল চালু থাকায় বৈধ করাতকলে কাঠ নিয়ে আসেন না ব্যবসায়ীরা। পৌরসভার ভেতরে ৫০টি বৈধ করাতকল রয়েছে। আমরা ব্যবসায়িকভাবে দিন দিন পথে বসতে চলেছি।’
সখীপুর আবাসিক মহিলা কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের প্রধান লুৎফর রহমান বলেন, এভাবে অবৈধ করাতকলে দিন-রাত বনের কাঠ চেরানো হলে আস্তে আস্তে এসব প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হয়ে যাবে। এর ফলে পরিবেশের ওপর এর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। দিন দিন বনায়ন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ায় গরমকালে প্রচ- গরম আর শীতকালে ব্যাপক শীত পড়ছে।
এ ব্যাপারে জানতে যোগাযোগ করা হয় টাঙ্গাইল বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) সাজ্জাদুর রহমানের সঙ্গে। সখীপুরের বনাঞ্চলে অবৈধ করাতকল গড়ে ওঠার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, আমাদের উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত রয়েছে। দ্রুতই ওই সব অবৈধ করাতকল উচ্ছেদে অভিযান চালানো হবে।