জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের উপকূলীয় এলাকা এবং উত্তরের চরাঞ্চল। তাই এসব এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত জনপদের উন্নয়ন ও জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনে নেওয়া প্রকল্পে জলবায়ু তহবিলের অর্থ বরাদ্দ বাড়ানোর বিষয়ে বিশিষ্টজনদের দাবি থাকলেও বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট চলছে উল্টো পথে।
নগরের রাস্তা এবং ড্রেন উন্নয়ন, বাতি স্থাপনসহ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে কোনো রকম সম্পৃক্ততা নেই-এমন সব প্রকল্পেও ব্যয় করা হচ্ছে জলবায়ু তহবিলের টাকা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পকে জলবায়ু অভিযোজনের নামে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে উত্থাপিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে জলবায়ু অর্থায়ন প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে এ চিত্র।
দেশে জলবায়ুর ঝুঁকি মোকাবিলায় ২০১০ সাল থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮৫১টি প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের তহবিল থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৭টি মন্ত্রণালয়ের ৭৯০ প্রকল্পের জন্য ৩ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা এবং অবশিষ্ট ৬১টি প্রকল্প পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। গত ১৩ বছরে তাদের নেওয়া প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনে নারী ও শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে
থাকলেও তাদের জন্য মাত্র ৩টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সাড়ে ৩ হাজার কোটির জলবায়ু তহবিলে নারী ও শিশুর জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা। প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাওয়ার কথা থাকলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দেওয়া মাত্র ৩টি প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাত্র ২২ কোটি টাকা। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের অনুমোদিত ৭৯০টি প্রকল্পের মধ্যে ৪৭৯টি পেয়েছে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয় এবং তাদের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ১৩৫ প্রকল্পে ১ হাজার ৫৭ কোটি টাকা, জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ৭৮ প্রকল্পে ৪৮৫ কোটি টাকা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের ৭৮ প্রকল্পে ৪৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় গবেষণাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা থাকলেও গত ১৩ বছরে গবেষণা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে মাত্র ২৬টি। অন্যদিকে ঝুঁকি মোকাবিলার এই ট্রাস্টের বরাদ্দের প্রায় ৬১ শতাংশই গেছে উন্নয়ন প্রকল্পের পেছনে। বিভাগগুলোর মধ্যে ঢাকায় ১৪১ প্রকল্পে ৬৪০ কোটি, চট্টগ্রামের ১৪২ প্রকল্পে ৬৩৯ কোটি, বরিশালে ১৩৯ প্রকল্পে ৭০৭ কোটি, খুলনার ৮৩ প্রকল্পে ৩০০ কোটি, রাজশাহীর ৮০ প্রকল্পে ২১১ কোটি, রংপুরের ৬৩ প্রকল্পে ১৮০ কোটি, সিলেটের ৪৫ প্রকল্পে ১৭২ কোটি এবং ময়মনসিংহের ৩৭ প্রকল্পে ১১৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অধিকাংশ প্রকল্পই দেওয়া হয়েছে দেশের বিভিন্ন জেলার পৌরসভাগুলোকে। প্রকল্পের টাকা দিয়ে পৌর এলাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা, পাবলিক টয়লেট নির্মাণ, বাতি স্থাপনের কাজ এমনকি সড়ক কাঠামোও গড়ে তোলা হয়েছে। এসব উন্নয়ন প্রকল্পকে জলবায়ু অভিযোজন নামে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাজেট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে জরুরি প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ অভিযোজন কার্যক্রম এবং জলবায়ু অভিঘাত সহিষ্ণুতা বাড়ানোর জন্য কাজ করেছে। প্রশমন কর্মসূচি বাস্তবায়নে বছরে ১১ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা প্রয়োজন।
প্রশমন কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে প্রিপেইড বিদ্যুৎ ও গ্যাস মিটার স্থাপন, এমআরটি ও বিআরটি বাস্তবায়ন, মাল্টি মোডাল হাব উন্নয়ন, রেলওয়ের জন্য আধুনিক রোলিং স্টক ও সিগন্যালিং সিস্টেম ক্রয় করা, এক্সপ্রেসওয়েজ নির্মাণ, পৌর কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ফ্যাসিলিটি ও বর্জ্য পানি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন ইত্যাদি কর্মসূচি। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ কাজগুলো সরকার বা সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থার নিয়মিত কাজ। এর সঙ্গে জলবায়ু সংশ্লিষ্টতা তেমন একটা নেই।
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইনে বলা আছে ট্রাস্টের তহবিলের অর্থ সরকারের চলমান উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন কর্মসূচির অতিরিক্ত হিসাবে জলবায়ু পরিবর্তন সংশ্লিষ্ট বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়নকল্পে ট্রাস্টের মাধ্যমে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য অভিযোজন, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং অর্থ এবং বিনিয়োগের জন্য ট্রাস্টি বোর্ড কর্তৃক প্রণীত নীতিমালা অনুসারে গবেষণামূলক কর্মকা-ে অর্থ বরাদ্দ করা হবে।
সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরামের (সাকজেএফ) মহাসচিব আসাদুজ্জামান সম্রাট বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের অভিযোজন ও প্রশমন খাতে বরাদ্দ দরকার। কিন্তু বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ কিংবা জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিল থেকে যেসব প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয় তার একটি বড় অংশই জলবায়ু সংশ্লিষ্ট নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের নামে বিভিন্ন পৌরসভার ড্রেনেজ নির্মাণ কিংবা সড়ক অবকাঠামো বা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অর্থ বরাদ্দ যুক্তিহীন। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ কিংবা উত্তরের নদী ভাঙনের শিকার জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষ বাস্তুভিটা হারিয়ে উদ্বাস্তু হচ্ছে। তাদের পুনর্বাসন বা কল্যাণে কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই।
তিনি বলেন, জলবায়ু তহবিলের অর্থ অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দের অন্যতম কারণ হচ্ছে এ নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা না থাকা এবং বাস্তবভিত্তিক জ্ঞান না থাকা ব্যক্তিরা এসব প্রকল্পে বরাদ্দ প্রদানের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকেন।
তিনি বলেন, ঝুঁকি মোকাবিলায় যা করা দরকার সরকারের পক্ষ থেকে তাই করা উচিত। ট্রাস্টের উদ্যোগ নেওয়া উচিত জলবায়ু সংশ্লিষ্ট অগ্রাধিকার খাতে তারা বরাদ্দ দেবে।
পানি ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের সদস্য অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের টাকা ব্যয় করা যাবে জলবায়ু সংশ্লিষ্ট ৪৬টি খাতে। কিন্তু টাকা ঠিকমতো খাতে খরচ হচ্ছে না। আমরা চাচ্ছি টাকাটা খরচ করা হোক গবেষণামূলক কাজ, মানুষের সক্ষমতা বাড়ানো, টেকনোলজি এবং অভিযোজনের কাজের জন্য। কিন্তু জলবায়ু ফান্ডের টাকা এতদিন যেভাবে খরচ হয়ে আসছে তা ঠিক হয়নি। ট্রাস্ট ফান্ড কর্তৃপক্ষ একটি নীতিমালা তৈরির চেষ্টা করছে। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক এটা করা সম্ভব হয়নি।
তিনি বলেন, জলবায়ু তহবিলের টাকা গবেষণামূলক ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সক্ষমতা বাড়ানোর প্রকল্পে ব্যয় করা উচিত।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা এবং অর্থায়নে বাংলাদেশ সরকারের বহুমুখী এবং যুগোপযোগী উদ্যোগ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর পরিবর্তে প্রভাবশালীদের কথা বিবেচনা করে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের ক্ষতিপূরণ দাবির স্থানটি দুর্বল হয়ে যাবে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় বরাদ্দকৃত অর্থের ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে করণীয় বিষয়াদি দেশের আইনি কাঠামোসহ সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন নীতি, পরিকল্পনা ও কৌশলগুলো স্থান পেয়েছে। সীমিত সম্পদ নিয়ে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত মোকাবিলায় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের সঠিক পথে রয়েছে। তিনি বলেন, জলবায়ু তহবিলের টাকা যাতে জলবায়ু সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে যথাযথভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয় সে বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ন্যাপ বাস্তবায়নে বিপুল অর্থায়নের জন্য দেশীয় সম্পদের বাইরে আন্তর্জাতিক উৎসগুলো হতে জলবায়ু অর্থায়ন এবং তহবিল সংগ্রহ এবং প্রকল্প প্রণয়নে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করা হচ্ছে।
তিনি জানান, গত ৮ বছরে জলবায়ু সম্পৃক্ত বরাদ্দ আড়াইগুণ বেড়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১২ হাজার ১৬৩ কোটি থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩৭ হাজার ৫১ কোটি টাকা হয়েছে।