গত কয়েকমাস ধরে সারাদেশে চলছে তীব্র দাবদাহ। এর মধ্যে বিদ্যুৎ বিভ্রাটও চরমে। ফলে স্বস্তির জন্য মানুষ দ্বারস্থ হচ্ছে চার্জার ফ্যানের। ঘরে-বাইরে এমনকি পথে-ঘাটেও মানুষের হাতে হাতে দেখা যাচ্ছে চার্জার ফ্যান। হঠাৎ তীব্র গরম ও বিদ্যুৎ বিভ্রাটে চার্জার ফ্যানের চাহিদা যেমন বেড়েছে, তেমনি এ সুযোগে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা কয়েকগুণ দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে চার্জার ফ্যান। এখন প্রশ্ন উঠেছে, এসব চার্জার ফ্যান কতটা মানসম্মত? যথাযথ নিয়ম মেনে প্রস্তুত হয়েছে কি এসব ফ্যান? এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় চার্জার ফ্যান বিস্ফোরণে শিশুসহ একই পরিবারের পাঁচজন দগ্ধের খবর শোনা যাওয়ায় চার্জার ফ্যানের মান নিয়ে দুশ্চিন্তা যেন আরও বেড়েছে।
চার্জার ফ্যান বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী, ফায়ার সার্ভিস ও ইলেক্ট্রনিকস পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানর কর্মকর্তারা বলছেন, ‘শুধু চার্জার ফ্যান নয়, সব ধরণের বৈদ্যুতিক ফ্যানই বিস্ফোরণ হতে পারে। এক্ষেত্রে চার্জার ফ্যানের ব্যাটারি ও সাধারণ ফ্যানের ক্যাপাসিটর বিস্ফোরণ ঘটে আগুন লাগতে পারে। এছাড়া পাওয়ার সার্কিট অথবা ট্রান্সফরমার, মোটর ড্রাইভার সার্কিট ও মোটরে আগুন লাগতে পারে। তবে চার্জার ফ্যানসহ মানসম্মত ইলেক্ট্রনিকস পণ্য কেনা ও যথাযথ সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করা গেলে এ ধরণের বিস্ফোরণ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব।’
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ঢাকা বিভাগ) দিনমনি শর্মা সময়ের আলোকে বলেন, ইলেক্ট্রনিকস পণ্য সামগ্রী ব্যবহারের নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। তেমনি চার্জার ফ্যান ব্যবহারেরও নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। এক্ষেত্রে ফ্যানের চার্জ শেষ হয়ে গেলে নির্দিষ্ট ঘণ্টা বা সময় পর্যন্ত চার্জ দিতে হয়। কিন্তু কোন নিয়ম না মেনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৈদ্যুতিক লাইনের সঙ্গে সংযুক্ত রেখে চার্জ দিতে থাকলে গরম হয়ে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। পরবর্তীতে বিস্ফোরণ থেকে ফ্যানের প্লাস্টিক অংশে বা বাসার কোথাও আগুন লেগে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
তিনি বলেন, সাধারণত ফ্যান বিস্ফোরণ ঘটে আগুন লেগে সে আগুন ঘরে থাকা বিছানা আসবাবপত্রে ছড়িয়ে গিয়ে মানুষের শরীরে লাগতে পারে। এছাড়া বিস্ফোরণের আগুনের ধোয়ায় মানুষের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়েও বড় ধরণের দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটতে পারে। তিনি মানসম্মত পণ্য ব্যবহারসহ সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে পরামর্শ দেন।
ইলেক্ট্রনিকস পণ্য উৎপাদন ও আমদানি সংশ্লিষ্ট একাধিক বিশেষজ্ঞ সময়ের আলোকে বলেন, একটি চার্জার ফ্যানে আগুন লাগার মতো ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস যন্ত্রপাতিগুলো হল- পাওয়ার সার্কিট অথবা ট্রান্সফরমার, মোটর ড্রাইভার সার্কিট, ব্যাটারি ও মোটর। এক্ষেত্রে ইলেকট্রনিকস সার্কিটের ডিজাইন সঠিক না হলে এর মধ্যে থাকে এমন সেমি কন্ডাকটর পার্টস, যেমন ক্যাপাসিটর, ট্রানজিস্টর, রেজিস্টর বা আইসি বিস্ফোরণের ফলে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। তাদের মতে, চার্জার ফ্যানের পাওয়ারের উৎস হিসেবে যে ব্যাটারি দেওয়া হয়, তাতে ডিসচার্জিং বা অভারচার্জিং প্রটেকশন থাকে। ফলে সার্কিটগুলোতে ব্যাটারি, মোটর বা সার্কিটের সঠিক কম্বিনেশন না থাকলে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
তারা আরও বলেন, গরমে চার্জার ফ্যানের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু অসাধু আমদানিকারক নিম্নমানের পণ্য আমদানি করে থাকে। আবার কিছু অদক্ষ লোক নিজেদের মতো করে চার্জার ফ্যানের মতো এমন সেনসিটিভ পণ্য বানানোর চেষ্টা করে। যে কারণে এ ধরনের ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। ফলে চার্জার ফ্যান ব্যবহারকারীদের পণ্য কেনার আগে গুনগত মান নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন দেখে কেনা উচিত।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিকস বিভাগের অধ্যাপক ও চার্জার ফ্যান গবেষক ড. জিয়াউর রহমান খান সময়ের আলোকে বলেন, চার্জার ফ্যানে লিথিয়ামের ব্যাটারি থাকলে অধিক গরম হয়ে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। আবার সার্কিট থেকে লুজ কানেকশন থাকলেও গরম হয়ে বিস্ফোরণ হতে পারে। এই অধ্যাপক বলেন, সাধারণত মানুষজন বাসা-বাড়িতে বিছানার ভেতরে চার্জার ফ্যান ব্যবহার করেন। এক্ষেত্রে বিস্ফোরণের পর আশপাশে কেরোসিন বা স্পিরিট জাতীয় দাহ্য পদার্থ থাকলে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে শুধু চার্জার ফ্যান নয়, সব ধরণের ইলেক্ট্রনিকস পণ্য ব্যবহারে সতর্ক থাকার কথা বলেন।