জাতীয় সংসদে উত্থাপিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধনী বিল পাশ হলে তা নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা আরও খর্ব করবে উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। প্রস্তাবিত সংশোধনী পাশ করা হলে কমিশনের নিকট নির্বাচনী আইনের লঙ্ঘনের কারণে যৌক্তিক বিবেচিত হলে যে কোনো নির্বাচনী এলাকায় চলমান নির্বাচন বাতিলের যে ক্ষমতা বিদ্যমান আইনে রয়েছে, তা কেড়ে নেওয়া হবে বলে মন্তব্য করেছে সংস্থাটি। শুক্রবার (৯ জুন) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টিকে নির্বাচনী ব্যবস্থায় “মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা” উল্লেখ করা হয়েছে।
সংস্থাটি জানায়, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, জাতীয় সংসদে উত্থাপিত সংশোধিত আরপিও অনুযায়ী এই ক্ষমতা হারাতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। বিদ্যমান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯১(ক) ধারায় বলা আছে, “নির্বাচন কমিশন যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে, নির্বাচনে বলপ্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন এবং চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সঙ্গত এবং আইনানুগভাবে নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করিতে সক্ষম হইবেন না, তাহা হইলে যে কোনো ভোট কেন্দ্র [বা, ক্ষেত্রমত, সম্পূর্ণ নির্বাচনি এলাকায়] নির্বাচনের যে কোনো পর্যায়ে ভোট গ্রহণসহ নির্বাচনি কার্যক্রম বন্ধ করিতে পারিবে।”
প্রস্তাবিত সংশোধনীতে ‘‘যে কোনো ভোট কেন্দ্র বা, ক্ষেত্রমত, সম্পূর্ণ নির্বাচনি এলাকায় নির্বাচনের যে কোনো পর্যায়ে ভোট গ্রহণসহ নির্বাচনি কার্যক্রম বন্ধ করিতে পারিবে’’ এই বিধানটিকে সুকৌশলে বাতিল করে শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ (পোলিং) বাতিল করার মধ্যে কমিশনের ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে এই সংশোধনীটি আইনে পরিণত হলে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে কমিশনকর্তৃক নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক নির্বাচন বন্ধ করার ক্ষমতা থাকবে না।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বিষয়টিকে নির্বাচনী ব্যবস্থায় “মড়ার ওপর খাড়ার ঘা” উল্লেখ করে বলেন, ‘গত বছর অক্টোবরে সিসিটিভি ক্যামেরায় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে অনিয়মের প্রমাণ পেয়ে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করেছিলো কমিশন। কমিশনের এই পদক্ষেপ ক্ষমতাসীন দলের দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে মর্মে পর্যবেক্ষকদের অনেকের মধ্যে যে ধারণা সৃষ্টি হয়েছিলো, এই সংশোধনী তার যথার্থতাই প্রতীয়মান করে। সংশোধনীতে প্রস্তাবিত “ইলেকশন” এর স্থলে “পোলিং” শুধু শব্দগত পরিবর্তন নয়, এর ব্যাপকতা আরো অনেক বেশি। এই বিল পাশের মাধ্যমে কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করা হলে তা দেশে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের সম্ভাবনা সম্পর্কে আস্থাহীনার সংকটকে আরো ঘনীভূত করবে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘গাইবান্ধা-৫ এর মতো দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে সক্ষম হবে এমন প্রত্যাশার পেছনে যুক্তি যেখানে একান্তই বিরল; বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সরকার, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিরপেক্ষ ও স্বার্থের দ্বন্দমুক্ত ভূমিকার সম্ভাবনা যেখানে মরিচীকার মতো, সেখানে এই সংশোধনী কমিশনের বিদ্যমান আইনগত সক্ষমতা যতটুকুই রয়েছে তাকেও নিজেদের স্বার্থে আরো গণ্ডিবদ্ধ করার উদ্যোগ ছাড়া কিছ্ইু নয়। নির্বাচনী অনিয়ম রোধে কমিশনের ক্ষমতা এভাবে খর্ব করা অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক। শুধু তাই নয়, প্রস্তাবিত সংশোধনীতে ঋণখেলাপী ও বিলখেলাপীদের জন্য সুযোগ বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যমান আদেশে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সাত দিন পূর্বে ব্যাংকঋণ ও বিভিন্ন পরিষেবার বিল পরিশোধের অনুলিপি জমা দেওয়ার বিধান থাকলেও, সংশোধনীতে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগের দিন পর্যন্ত সে সুযোগ রাখা হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে, ঋণখেলাপী ও বিলখেলাপীদের নির্বাচনে উৎসাহিত করা হচ্ছে- এমন ধারণা জোরালো হওয়া মোটেই অমূলক নয়।’
টিআইবি সংশোধনী প্রস্তাবটি বাতিলের আহ্বান জানানোর পাশাপাশি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার চর্চার স্বার্থে নির্বাচনকালীন সরকার, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিরপেক্ষ ও স্বার্থের দ্বন্দমুক্ত ভূমিকা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানায়।