ই-পেপার বিজ্ঞাপনের তালিকা সোমবার ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০ আশ্বিন ১৪৩০
ই-পেপার সোমবার ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩
https://www.shomoyeralo.com/ad/Amin-Mohammad-City-(Online).jpg

https://www.shomoyeralo.com/ad/SA-Live-Update.jpg
লেখক এবং লেখক
শিহাব সরকার
প্রকাশ: শুক্রবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ৪:০৭ এএম | অনলাইন সংস্করণ  Count : 125

১৯৭৪ সালের কথা। এক দুপুরে কথাচ্ছলে আলমগীর ভাই বললেন, ‘ইমদাদুল হক মিলন নামে এক তরুণ ভালো গল্প লিখছে। পড়বেন।’ 

ছোটগল্প নিয়ে কথা হচ্ছিল ওই সময়ের ‘সাপ্তাহিক সিনেমা’ পত্রিকায় আলমগীর ভাইয়ের টেবিলে। চারজন মিলে আড্ডা হচ্ছিল। ছিলাম সাপ্তাহিক সিনেমার নির্বাহী সম্পাদক আলমগীর রহমান, আমাদের আলমগীর ভাই, নিরীক্ষাধর্মী গল্পের লিটল ম্যাগাজিন ‘ছোটগল্প’-এর সম্পাদক কামাল বিন মাহতাব, ‘সিনেমা’ পত্রিকার সাংবাদিক আখতারুন্নবী এবং আমি। আমি তখন দৈনিক বাংলার বাণী গ্রুপের সিনেমায় ফিচার বিভাগে কাজ করি। ওটাই আমার জীবনে প্রথম বড় পত্রিকায় সাংবাদিকতা। আলমগীর ভাইয়ের কথায় আমরা সবাই একটু নড়েচড়ে বসলাম। কারণ তিনি ওই সময় ছোটগল্পের আঙ্গিক ও বিষয় নিয়ে বিস্তর চিন্তাভাবনা করছেন। আখতারুন্নবী উর্দু থেকে সাদত হাসান মান্টো, খাজা আব্বাস এবং কৃষণ চন্দরের মতো লেখকদের গল্প অনুবাদ করেন। আর তরুণ কবি আমি, কবিতায় পুরোপুরি ডুবে থেকেও ছোটগল্প লিখে যাচ্ছি। লেখালেখির শুরু থেকেই ওটা আমার প্রিয় মাধ্যম।

আলমগীর ভাই তিনজনকে মিলনের গল্প পড়ার জন্য অনুরোধ করলেন। ততদিনে সাপ্তাহিক সিনেমায় লেখকের নিয়মিত গল্প ছাপা হতে শুরু করেছে। আমি পড়ে ফেলেছি ওর গল্প সিনেমা এবং অন্যান্য পত্রিকায়। ১৯৭৩ সালে ছাপা হয় মিলনের ছোটগল্প ‘বন্ধু’। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার এবং অন্যদের সঙ্গে বাংলার বাণী গ্রুপের কর্ণধার শেখ ফজলুল হক মণিও নিহত হন। এরপর ওই ভবনের সিনেমাসহ সব পত্রিকা বন্ধ হয়েযায়। প্রকাশনা বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত ইমদাদুল হক মিলন সিনেমা পত্রিকায় নিয়মিত গল্প লিখেছেন। যদিও আলমগীর রহমান আগস্টের আগেই ওই কাগজ ছেড়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় যোগ দেন। পরে তিনি গড়ে তোলেন তার প্রকাশনা সংস্থা অবসর ও প্রতীক।
ইমদাদুল হক মিলনের শুরুপর্ব অনেক গদ্যশিল্পীর চেয়ে পৃথক। প্রথম গল্প থেকেই বোঝা যাচ্ছিল, নতুন মেজাজের এক লেখক আসছেন বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে। মিলনের প্রথম দিকের গল্প ও উপন্যাস ছিল খাঁটি তারণ্যের স্ফুর্তিতে সতেজ, অনুসন্ধিৎসু ও মনোগ্রাহী।

পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি আয়ত্ত করেন এমন এক ভাষাশৈলী, যা অল্প সময়ের ভেতর তার নিজস্ব পাঠকমণ্ডলী তৈরি করে। তখন তিনি বয়সে তরুণ, জীবনের অলিসন্ধি মাত্র চিনতে শুরু করেছেন
কখনো তিনি বিশুদ্ধ এক দর্শক, কখনো মানব-মানবীর সম্পর্কের প্রহেলিকায় বিমূঢ়, কখনো রক্তাক্ত
মিলন ধীরে ধীরে প্রবেশ করলেন বেঁচে-থাকা নামক নাটকের বিশাল মঞ্চে। তখন আশির দশক চলছে। এরই মধ্যে বেরিয়ে গেছে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে প্রবাসজীবন শেষ করে দেশে ফিরে লেখা তার ‘পরাধীনতা’, ‘নদী উপাখ্যান’, ‘ভূমিপুত্র’, ‘কালাকাল’, ‘দুঃখ-কষ্ট’, ‘এক দেশ’ ইত্যাদি উপন্যাস। নব্বই দশকের শুরুতে ইমদাদুল হক মিলন আমাদের গদ্যসাহিত্যের এক উজ্জ্বল তারকা। তিনি হুমায়ূন আহমেদের প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বী জনপ্রিয়তার বিচারে। মিলন প্রস্তুতি নিয়েই সাহিত্যে এসেছিলেন। কারণ প্রথম পর্যায়ে তার উপন্যাস ও গল্প ছিল ধ্রুপদী ছকে বাঁধা, আবেগ ছিল নিয়ন্ত্রিত এবং তিনি প্রয়োগ করে যাচ্ছিলেন এক স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষণশক্তি। ওই সময় এবং বিরতি দিয়ে দিয়ে পরেও, সব বয়সের সাহিত্যমনস্ক পাঠক তার লেখায় মগ্ন থাকার সময় অবচেতনভাবে 
 অপেক্ষা করতেন একটি মেসেজ বা বাণীর জন্য। তার সমসাময়িক এবং অগ্রজ অনেক লেখকের ক্ষেত্রে এটা দেখা যায় না। ওই সময় এবং পরবর্তী পর্যায়ে তিনি যেমন দুই হাতে তরুণ-তরুণীর হার্দ সম্পর্ককে মূল বিষয় করে লিখেছেন, একই সঙ্গে পাঠককে দিয়ে গেছেন কিছু বড় কাজ। লঘু মেজাজের গদ্যকর্মের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সামনে তিনি ওই সময় হাজির করেন সাহিত্যমানের নিরিখে উল্লেখযোগ্য বেশ কয়েকটি উপন্যাস। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে ‘মহাযুদ্ধ’, ‘বনমানুষ’, ‘যাবজ্জীবন’ ইত্যাদি।

লঘু ও গুরু-এ দুই মেজাজের উপন্যাস প্রায় সমান স্বাচ্ছন্দ্যে লেখার বিবেচনায় মিলন সম্ভবত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে তার ‘রোল মডেল’ হিসেবে স্থাপন করেছেন-এ রকম দাবি অনেক পাঠক ও সমালোচকের। বাংলা সাহিত্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পাঠকপ্রিয়তা একটি ঘটনা বা ফেনোমেনোন। হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রে এই সত্য যেমন খেটে যায়, তেমনি ইমদাদুল হক মিলনের বেলায়ও অনেকটা। জনপ্রিয়তা সাহিত্যকর্মের মান বা বিশেষ কোনো অঞ্চলের সাহিত্যে লেখকের স্থান নির্ণয়ের মাপকাঠি নয়, একাধারে জনপ্রিয় ও শক্তিমান লেখকরা এটা ভুলে যান না। হয়তো এ কারণে এই তিন লেখক এবং দুই বাংলায় এদের মতো আরও অনেকে রচনা করেছেন এমন কিছু উপন্যাস, যা সাহিত্যে তাদের স্থানকে অমলিন রাখবে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শেষ পর্যায়ে এসে ডুবে গিয়েছিলেন গবেষণাধর্মী ও ঐতিহাসিক পটভূমির উপন্যাস রচনায়, বিশাল সেসব কাজের পটভূমি। অগুনতি বাস্তব ও কাল্পনিক চরিত্র ও ঘটনা ওসব উপন্যাসকে দিয়েছে অনন্য এক মাত্রা। হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক উপন্যাসসহ আরও কয়েকটি ঐতিহাসিক কাজ নিয়ে পাঠকের সামনে এসেছেন তার নিজস্ব ভঙ্গিতে। এখানে বরাবরের মতো সক্রিয় তার জাদুকরী ভাষা ও আঙ্গিক। আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি, ঐতিহাসিক বা রূঢ় বাস্তবের ঘটনানির্ভর উপন্যাস রচনার সময় মিলন কল্পনাশক্তি প্রয়োগের চেয়ে বাস্তবানুগ থাকার ব্যাপারে অধিকতর মনোযোগী। এটি আমাদের মনে আসে তার এই চরিত্রের উপন্যাস ও গল্প পাঠের সময়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘দেশ ভাগের পর’, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘কালোঘোড়া’ ও ‘ঘেরাও’। সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা মিলনের ‘নূরজাহান-১’ এবং ‘নূরজাহান-২’ একজন ক্ষক্ষমতাবান কথাশিল্পী হিসেবে সাহিত্যে তার স্থানকে উজ্জ্বলতর করেছে।

উল্লেখ না করলেই নয় ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’ শিরোনামের অসাধারণ ছোটগল্পটির কথা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গুণমুগ্ধ, গ্রাম থেকে আসা একটি সরল-সোজা মানুষকে নিয়ে মিলনের গল্পটি। রতন মাঝি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে এসে ঘোরাঘুরি করছিল চৌদ্দই আগস্ট সন্ধ্যায়। ওর হাতে ছোট একটা পুঁটলি, যাতে আছে নিজের ক্ষেতে লাগানো কালিজিরা ধান থেকে কোটা ‘পৌনে দুসের’ চিঁড়া। রতন নিজে এই উপহারটুকু বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল। দুর্ভাগ্য তার। টহল পুলিশ সন্দেহ করে তাকে থানায় নিয়ে আসে। পরদিন পনেরোই আগস্ট ভোরে জানা গেল, নেতা রাতে নিহত হয়েছেন। রতন মাঝিকে পুলিশ রাতেই লকআপে পুরে দিয়েছে। সকালে ওরা বুঝতে পারে লোকটি নির্দোষ। ওরা রতনকে ছেড়ে দেয়। অনেক লেখক বিধ্বস্ত ও বিষণ্ন মুখে রতন মাঝির চলে যাওয়ার দৃশ্যের ভেতর দিয়ে গল্পটি শেষ করতেন হয়তো। কিন্তু মিলন এখানে ওই রাতে দেশের মানুষের ভেতর জ্বলে ওঠা ক্ষোভের শিখাকে প্রজ্বালন করেছেন রতনের সত্তায়। রতন মুক্তি পেয়েও থানা ছাড়তে চায় না। অফিসারের চোখে চোখ রেখে ও শীতল গলায় উচ্চারণ করে, ‘আমাকে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না সাহেব। আমাকে হাজতেই রাখুন। ছেড়ে দিলে নেতা হত্যার প্রতিশোধ নেব আমি।’ গল্পের এই নিজস্ব ধরনের ইতি টানার ভেতর আবিষ্কার করা যায় সত্য, সরলতা ও বাস্তবের প্রতি লেখকের অঙ্গীকার। আর এখানেই ইমদাদুল হক মিলনের স্বাতন্ত্র্য।

মিলনের বাল্যকাল কেটেছে বিক্রমপুর এলাকার মেদিনীমণ্ডলে, নানাবাড়িতে। সেই সূত্রে গ্রামজীবন খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ হয়েছে তার। তার শৈশবে দেখা মানুষ এবং ভেতর-বাইরের দৃশ্যাবলি আমাদের মনের গভীরে দাগ কেটে যায়। একজন সৃজনশীল মানুষের জন্য এটি পরম সম্পদ। গ্রাম নিয়ে ছোটবেলার স্মৃতিকে মিলন নিপুণভাবে ব্যবহার করেছেন তার গদ্যকর্মে। এই সূত্রে লেখকের ‘বাঁকাজল’ উপন্যাসটির নাম করতে হয়। এতে গ্রামীণ বর্ষা, ডুবে যাওয়া মাঠঘাট এবং বাড়িঘরের যে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা পাই, তা শুধু গ্রামে শৈশব কাটানো একজন লেখকের কাছ থেকেই আশা করা যায়। সম্ভবত লেখক গ্রামের সঙ্গে কখনোই সম্পর্কচ্ছেদ করেননি। এ জন্য গ্রামীণ জীবন, গ্রামের নানা শ্রেণির মানুষ তার অন্যান্য লেখায়ও গাঢ় ছায়া রেখে গেছে। বালকবেলার পর মিলনের স্থায়ী বসবাস ঢাকা নগরীতে। এখানেই তার বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া ও জীবন-জীবিকা। আসলে লেখকের বেশিরভাগ গদ্যকর্ম নগরকেন্দ্রিক। কৈশোর থেকে এই শহরকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। বাংলাদেশের আরও অনেক ঔপন্যাসিকের মতো মিলন ঢাকার মূল সত্তার সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দিয়েছেন। ফলে এ নগরীর নানা স্তরের মানুষকে বিভিন্ন দিক থেকে আবিষ্কার করতে গিয়ে তাকে খুব চেষ্টা করতে হয়নি। এরা সবাই তার খুব পরিচিত। স্বাচ্ছন্দ্যে এরা তার গল্প-উপন্যাসের ক্যানভাসে চলে আসে।

ইমদাদুল হক মিলন গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি কিশোরদের জন্যও লিখেছেন। তার মোট বইয়ের সংখ্যা দুইশ ছাড়িয়ে গেছে। এসবের বাইরে তিনি অজস্র একক ও ধারাবাহিক টিভি নাটক লিখেছেন। তার একটি উল্লেখযোগ্য কাজ শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’ উপন্যাসকে ধারাবাহিক টিভি নাটকে রূপান্তর। বহুমুখী তার সৃজনশীলতা। ‘কী কথা তাহার সনে’ শিরোনামের একটি নিয়মিত সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানও করেছেন টেলিভিশনে। একপর্যায়ে জড়িয়ে যান সাংবাদিকতায়। এখন দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তিনি ওই পেশার সঙ্গে যুক্ত। মিলন প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্যের একটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করতেই হয়। এখানকার জনপ্রিয় লেখকরা শেষ পর্যন্ত শুধু লেখক থাকেন না। শিল্পসাহিত্য, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের বিভিন্ন দিকের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ার ফলে এরা একসময় হয়ে ওঠেন অতিচেনা, যাদের সবাই এক নামে চেনে। এ তালিকায় ইমদাদুল হক মিলনের নাম উঠে গেছে বহু আগেই। এসব সত্ত্বেও তার গভীর সাহিত্যপ্রেম আমাদের মুগ্ধ করে। সব শেষে খাঁটি সাহিত্যকর্মই একজন কথাশিল্পী বা কবিকে বাঁচিয়ে রাখে। সময়ের নির্মম ডাস্টার ব্ল্যাকবোর্ড থেকে মুছে দেয় আর সব পরিচয়। স্বস্তির কথা, ইমদাদুল হক মিলনের লেখক পরিচয়ই শেষ পর্যন্ত আমাদের মনে গেঁথে থাকে।


সময়ের আলো/আরএস/ 






https://www.shomoyeralo.com/ad/Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড
এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫। ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com