ই-পেপার বিজ্ঞাপনের তালিকা সোমবার ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০ আশ্বিন ১৪৩০
ই-পেপার সোমবার ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩
https://www.shomoyeralo.com/ad/Amin-Mohammad-City-(Online).jpg

https://www.shomoyeralo.com/ad/SA-Live-Update.jpg
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকৃতির ভেতর দিয়ে পরমাত্মার সন্ধানে
ড. সরকার আবদুল মান্নান
প্রকাশ: শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ১২:৩১ পিএম | অনলাইন সংস্করণ  Count : 131

সুপ্রাচীনকাল থেকে ভারতবর্ষের জীবন ও জগতের সঙ্গে প্রকৃতি আর নিসর্গ গভীরের আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। বৃক্ষ-বিটপি-গুল্ম আর লতাপাতা-ফুল-ফল ও পত্রপল্লবে আচ্ছাদিত এই জীবন আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে, ধর্ম ও দর্শনে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। সেই গভীর অরণ্যানীর মধ্যে স্থাপিত হয়েছে তপোবন, শক্তি জুগিয়েছে তপস্যায় ও জ্ঞানচর্চায়। প্রাচীন ভারতবর্ষের পণ্ডিতগণ, ঋষিগণ, কবি-সাহিত্যিক ও দার্শনিকগণ স্নিগ্ধ অন্ধকারাচ্ছন্ন গভীর বনের নির্জনতায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন এবং সেই ধ্যানমগ্নতার ভেতর দিয়ে তারা জীবন ও জগতের রহস্য উন্মোচন করার চেষ্টা করতেন। ফলে ভারতবর্ষীয় জ্ঞানকাণ্ড আর 

প্রকৃতি পারস্পরিকতায় লীন হয়ে আছে। রামায়ণ-মহাভারত থেকে শুরু করে উপনিষদগুলোর মধ্যে এবং সর্বোপরি কালিদাসের কাব্যগুলোতে প্রকৃতি একটি জীবন্ত সত্তা হিসেবে স্থান পেয়েছে। তারই উত্তরসাধনার পথ ধরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায়, গানে, গল্পে, উপন্যাসে, চিঠিপত্রে, স্মৃতিকথায় নিসর্গ ও প্রকৃতি নানাভাবে ধরা দিয়েছে। তার রচনায় ঔপনিষদিক জীবনাদর্শের ঐশ্বর্যে চিরায়ত ভারতবর্ষের মহিমা কতভাবে যে বাক্সময় হয়ে উঠেছে, তার ইয়ত্তা নেই। তারই অন্য এক রূপ লক্ষ করা যায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনায়। তিনি প্রকৃতিকে আলাদা কোনো সত্তা হিসেবে গ্রহণ করেননি। বরং মানবীয় চরিত্রের মতো তিনি প্রকৃতি ও নিসর্গকেও একটি প্রাণবন্ত চরিত্র হিসেবেই তুলে ধরেছেন। সুতরাং ওই ধারায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকৃতিকে যে মানবজীবনের মতোই একটি নিত্য চলিষ্ণু ও প্রাণচঞ্চল আলেখ্য হিসেবে তার অনুপুঙ্খ উন্মোচন করেছেন, তার মধ্যে মানুষ প্রকৃতির সন্তানের মতোই ক্রীড়াশীল।

প্রকৃতি-ভাবনার এই ধারায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় যে জীবনবোধ রচনা করেছেন, সেখানে তিনি প্রকৃতিকে কোনো দর্শন হিসেবে গ্রহণ করেননি। উপনিষদ কিংবা কালিদাস কিংবা রবীন্দ্রনাথের জীবনাকাক্সক্ষার মতো তার রচনায় প্রকৃতি কোনো জীবনাদর্শন হিসেবে উপস্থাপিত হয়নি। বরং মানুষ ও প্রকৃতির অভিন্নতার পটভূমিতে তিনি রচনা করেছেন তার গল্প-উপন্যাসগুলো। তার সেই সৃষ্টির ভেতরে যদি কোনো দর্শন কিংবা কোনো তথ্য বা তত্ত্ব থেকে থাকে, তা একান্তই সমালোচকদের অন্বেষণের বিষয়। কিন্তু বিভূতিভূষণের ব্যক্তিগত কোনো আদর্শ, কোনো দর্শন বা কোনো তথ্য ও তত্ত্বের ছিটেফোঁটাও তার রচনার মধ্যে লক্ষ করা যায় না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিছু কিছু উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই তিনি মার্কসীয় ও ফ্রয়েডীয় জীবনাদর্শকে তার কথাসাহিত্যের প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। সে সময় কেউ কেউ তাদের সৃষ্টির ভেতর দিয়ে অস্তিত্ববাদ, পরাবাস্তববাদ বা স্যুর রিয়ালিজম, চেতনাপ্রবাহ ইত্যাকার নানা মতবাদ ও মতাদর্শ ফলিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এ ধরনের কোনো মতাদর্শ কখনোই গ্রহণ করেনি। অধিকন্তু খুব শৈশব থেকে নিবিড়ভাবে গ্রামীণ যে জীবন তিনি দেখেছেন, যে জীবনের ভেতরে থেকে তিনি বেড়ে উঠেছেন, সেই জীবনের অনুপুঙ্খ বিবরণ তুলে ধরেছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সুতরাং তার কথাসাহিত্য দারিদ্র্যের নয়, দুঃখের নয়, বঞ্চনার নয় এবং প্রেম বা দ্রোহের নয়, যৌনতার নয়- অধিকন্তু জীবন তার আপন স্বভাবে উন্মোচিত হয়েছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে ও উপন্যাসে। দিনলিপিতে তিনি লিখেছেন, ‘পাহাড়ে পাহাড়ে আগুন দিয়েছে। বড় সুন্দর দৃশ্য। এই বিশ্ব প্রকৃতিকে ভগবানের রূপ বলে উপাসনা করব। সব দিকে তাই, যখন দেখি কচি পাতা ওঠা শালবন- তখনই ভাবি হে অনন্ত ভগবান, এই আপনি নানা রূপে সামনে। এই কথাটা ভাবলে নতুন নতুন প্রাকৃতিক দৃশ্য এর দিক থেকে নয়- একটা আধ্যাত্মিক আনন্দ এর সঙ্গে জড়ানো থাকবে। সব প্রাকৃতিক দৃশ্যই তার রূপ। তিনি নানা রূপে। আনন্দকর তার রূপ দেখো। এই করছি রোজ।’ ‘দিনলিপি’ থেকে আরও খানিক তুলে ধরি। ‘আবার ঠিক তার ওপর সেই সময়েই এক বিচিত্র বর্ণের প্রজাপতি- একটা ফুলে সে প্রজাপতিটা বসল। মাথার ওপরে কতকাল পরে আজ গাঢ় নীলাকাশ, চারপাশে গরম শরতের পরিপূর্ণ রোদ আর রোদের সামনে ঘন সবুজ ঝোপের মাথায় এই অপূর্ব ফুটন্ত বনকলমী ফুলের দৃশ্য- একটা ফুলে প্রজাপতি বসেছে। এ দৃশ্য আমায় মুগ্ধ, বিস্মিত, স্তম্ভিত করলে। ভগবান কি দয়া আমার ওপর করলেন যে আমায় আজ এ দৃশ্য দেখালেন। আমার তো এ পথ দিয়ে যাওয়ার কথা নয়। ইন্দু বললে, চলুন আজ এ পাড়ার ঘাটেÑতাই গেলুম। জয় হোক, বিশ্বশিল্পী, জয় হোক তোমার। ঘাটের দৃশ্যও চমৎকার। ঘাস ছুঁয়ে আছে জল। নীল আকাশ। অনেক দিন পরে এমন রোদ, এমন আকাশ।’

এই হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবনার জগৎ। রৌদ্রোজ্জ্বলের দিনে ফুলে প্রজাপতি, নীল আকাশ, জলছোঁয়া সবুজ ঘাস একজন লেখককে এতটা মুগ্ধ করতে পারে এবং ওই দৃশ্যটুকু দেখার জন্য নিজেকে তিনি কতটা সৌভাগ্যবান জ্ঞান করতে পারেনÑএই বোধ এবং এই তীব্র অনুভবশক্তি প্রায় বিরল ঘটনা। একজন মানুষের মনের গড়ন এবং চিন্তা ও কল্পনাপ্রতিভার গড়ন কতটা প্রকৃতিনিবিষ্ট হলে এমন করে ভাবা যেতে পারে! ফলে অনিবার্যভাবেই সময়ের বিচিত্র বিক্ষোভ থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে নিয়ে একান্তভাবে 

প্রকৃতির মধ্যে ডুব দিতে পেরেছিলেন। অথচ আমরা জানি তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস, হিংসা, বিদ্বেষ ও নতুন করে যুদ্ধের ডামাডোল প্রকট হয়ে উঠেছিল। শিল্প ও পুঁজির বিকাশে বিশ্বের দেশগুলোকে বাজারে পরিণত করার কাড়াকাড়ি শুরু হয় ওইসব সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর মধ্যে। উপনিবেশগুলোতে শুরু হয় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের সংগ্রাম। দেশে দেশে সমাজতন্ত্রের তখন জয়জয়কার। মানুষের মধ্যে নিঃসঙ্গতা, অস্থিরতা ও অসহায়ত্ব প্রকট আকার ধারণ করেছিল। সেই সময় শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, পৃথিবীর সব দেশের সাহিত্যে ভিন্ন এক জীবনাকাক্সক্ষা প্রকটভাবে ধরা দেয়। মানুষের দারিদ্র্য, অসহায়ত্ব, বঞ্চনা, সংগ্রাম, সংক্ষুব্ধতা, রিরংসা শিল্প-সাহিত্যের সাধারণ বিষয় হয়ে ওঠে। রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা কথাসাহিত্যে এই অস্থির জীবন এবং সেই জীবনের বিচিত্র হাহাকার, যন্ত্রণা ও রক্তক্ষরণের চিত্র প্রায় সব কবি ও কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে প্রবলভাবে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সমকালের সেই জীবনের প্রতি বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে তিনি তার পথেই নিষ্ঠার সঙ্গে নিবিষ্ট থেকেছেন। এই প্রসঙ্গে পরিমল গোস্বামী তার ‘বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) নামক এক স্মৃতিচারণে লিখেছেন, ‘তিনি তার শিল্পীসত্তায় ছিলেন দৃঢ়প্রত্যয়ী, এবং শিল্পীরূপে কোনো সস্তা খ্যাতি লাভের প্রবৃত্তি তার কখনো হয়নি। তার শিল্পীমনের নিজস্ব একটি স্তর ছিল, তার চেহারা আলাদা। তাকে তার পথের পাঁচালী, আরণ্যক বা দৃষ্টিপ্রদীপ নিয়ে চটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে দেখেছি, তা কিছুমাত্র তার অন্তরে পৌঁছত না। তার শিল্পধর্মে এমন একটি পরিপূর্ণ নিমগ্নতা ছিল যে, আমার রহস্যচ্ছলে বলাকে তিনি হেসে উড়িয়ে দিতে পারতেন।’

এই যে প্রকৃতি-ভাবনা, তার মূলগত উৎস কোথায়? তিনি কি শুধু প্রকৃতির বিচিত্র রহস্যের মধ্যেই পাঠকদের নিমজ্জিত রাখতে চেয়েছিলেন, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো গভীর তাৎপর্য নিহিত আছে? কখনো কখনো মনে হয়, তিনি মহাবিশে^র পরম আত্মার সঙ্গে মানুষকে নিবিড়ভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছেন, যে পরম আত্মা প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানের মধ্যে আপন স্বভাবে লীন হয়ে থাকে। না হলে কেন তিনি এক জীবন দুর্বিনীত এক পৃথিবীর অধিবাসী হয়েও প্রকৃতিকেই পরম আত্মীয় হিসেবে জ্ঞান করেছেন? পথের পাঁচালী উপন্যাসের ইন্দির ঠাকুরুন থেকে শুরু করে অপু, দুর্গা ও হরিহরের যে জীবন তিনি রচনা করেছেন কিংবা আরণ্যক উপন্যাসে সত্যচরণ, রাজু পাঁড়ে, ধাতুরিয়া, ধাওতাল সাহু, মটুকনাথ পাঁড়ে প্রভৃতি চরিত্রের মধ্য দিয়ে যে চরিত্রটিকে কেন্দ্রে স্থাপন করেছেন সে মানুষ নয়- প্রকৃতি, জঙ্গল। আর অরণ্যকের ওই জীবনের সঙ্গে হুবহু মিলে যায় বিভূতিভূষণের ব্যক্তিগত জীবন। দিনলিপি গ্রন্থের ১৯২৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ‘স্মৃতির রেখা’তে তিনি লিখছেন, ‘এই জঙ্গলের জীবন নিয়ে একটা কিছু লিখবো- একটা কঠিন শৌর্যপূর্ণ, গতিশীল, ব্রাত্য জীবনের ছবি। এই বন, নির্জনতা, ঘোড়ায় চড়া, পথ হারানো অন্ধকার নির্জনে জঙ্গলের মধ্যে খুপরি বেঁধে থাকা। মাঝেমধ্যে যেমন আজ গভীর বনের নির্জনতা ভেদ করে যে শুড়ি পথটা ভিটে-টোলার বাথানের দিকে চলে গিয়ে দেখা গেল, ঐ রকম শুড়ি পথ এক বাথান থেকে আর এক বাথানে যাচ্চে- পথ হারানো, রাত্রের অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে ঘোড়া করে ঘোরা, এ দেশের লোকের দারিদ্র্য, সরলতা, এই ধপঃরাব ষরভব, এই সন্ধ্যায় অন্ধকারে ভরা গভীর বন ঝাউবনের ছবি এই সব।’ আরণ্যকে উল্লিখিত গোষ্ঠবাবু মুহুরী, রামচন্দ্র আমীন, আসরফি টিন্ডেল, জয়পাল কুমার, পণ্ডিত মটুকনাথ এবং রাখাল ডাক্তারের স্ত্রীর কথা ওই দিনলিপিতেও পাওয়া যায়। 

অস্থির পৃথিবীতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের জন্য অন্য এক জীবনের আকাক্সক্ষা তৈরি করেছেন, যেখানে আমরা নিশ্চিন্তে আশ্রয় নিতে পারি। যে জীবন তিনি রচনা করেছেন, সেই জীবনে প্রতিজন বাঙালির শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের দুর্দান্ত সময়গুলো আনন্দিত অধ্যায়ের মতো উজ্জ্বল হয়ে আছে। আমাদের নিত্যদিনের জীবনকে পরম এক আনন্দে অভিষিক্ত করে তোলেন তিনি এবং আমরা প্রকৃতির সন্তান হিসেবে নিজেদের আবিষ্কার করার সুযোগ পাই। আমার মনে হয়, এখানেই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আধুনিকতা ও চিরকালীনতা।

সময়ের আলো/জেডআই




https://www.shomoyeralo.com/ad/Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড
এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫। ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com