জীবদ্দশায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা মাত্র ছয়টি। মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় আরও একটি উপন্যাস। এ ছাড়া প্রকাশিত, অপ্রকাশিত, অগ্রন্থিত লেখা অর্থাৎ উপন্যাস, গল্প, অনুবাদ নিয়ে প্রকাশিত হয় কিছু সংকলন। তা দিয়েই দোর্দ- প্রতাপের সঙ্গে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাচ্ছেন এখনও। তিনি শহীদুল জহির। সময়টা তখন আশির দশক। প্রায় দশ বছরের লেখা গল্পগুলো থেকে যাচাই-বাছাই করে ১৯৮৫ সালে প্রকাশ করেন ‘পারাপার’। ‘মুক্তধারা’ বের করেছিল বইটি। বইয়ের দুয়েকটি গল্প কোনো কোনো কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল আগেই। তিনি তখনও শহীদুল জহির হননি। ‘পারাপার’ বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় শহীদুল হক নামেই।
শহীদুল জহিরের গদ্যভাষা, গল্প বলার ভঙ্গি আলাদা। ব্যতিক্রম। যদিও আমরা তার ভাষার ওপর সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রভাব খুঁজে পেতে পারি। অনেকে সেখানে সৈয়দ শামসুল হকের প্রভাবও দেখতে পান। কেউ কেউ টানেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে। মূলত একজন লেখক অনেক কিছুকেই আত্মস্থ করে পথ নির্মাণ করেন। আমরা যদি আজ তার নির্মিত পথের দিকে তাকাই, তা হলে তা একান্তই শহীদুল জহিরীয় বলে প্রতিভাত হয়।
শহীদুল জহিরের লেখায় এক ধরনের ঘোর আছে। তার লেখা পাঠের পরে গল্পটুকু বুঝে উঠুক আর না উঠুক- এক ধরনের ঘোরে আচ্ছন্ন হতে হয়। অথচ তার গদ্য ভাষা সহজ নয়। সাবলীল নয়। আমরা যদি শহীদুল জহিরের প্রথম উপন্যাস ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’র দিকে তাকাই, দেখব তিনি এক কথা বলতে বলতে পরবর্তী লাইনে অন্য একটি কথা বলছেন। নিঃসন্দেহে যার সঙ্গে তাল মেলানো পাঠকের জন্য কঠিন। নিঃসন্দেহ যা পাঠকের পূর্ণ মনোযোগ দাবি করে। এই দুর্বোধ্য ভাষার প্রাচীর ভেঙে পাঠক শহীদুল জহিরকে আপন করে নিয়েছেন। তা যেমন অভাবনীয়, ঠিক তেমনই শহীদুল জহিরের শক্তিমত্তারই পরিচায়ক।
শহীদুল জহির গল্প বলেন সংশয়, দ্বিধা, সন্দেহ নিয়ে। আপাতত দৃষ্টিতে মনে হয়, তিনিও তার নির্মিত চরিত্রকে যেন ঠিকমতো চিনতে পারছেন না। ফলে দ্বিধায় ভুগছেন। বিষয়টি বোঝানোর জন্য তার ‘কার্তিকের হিমে, জ্যোৎস্নায়’ গল্পের শুরু থেকেই যৎকিঞ্চিৎ তুলে ধরছি। ‘তবু এটা ফৈজুদ্দিনের গল্প। অথবা কার? ফৈজুদ্দিন হচ্ছে ফজু, সুহাসিনী গ্রামের ছোট অথবা ভূমিহীন কৃষক, হয়তো ক্ষেত মজুরই, ফলে সে গরিব এবং স্বাস্থ্যহীন রোগা টিঙাটিঙা, হয়তো সে কিঞ্চিৎ একজন পিপুফিশু অর্থাৎ অলস এবং সে কারণেই সে হয়তো ছিল দার্শনিক।’
এই যে ‘তবু’, ‘অথবা’, ‘হয়তো’র ব্যবহার, এই যে সংশয়, এই সংশয়ই পাঠকদের একই পাটাতনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। আমাদের আশপাশের যে জগৎ, যে মানুষ, জন, তাদের কি আমরা সত্য সত্যই চিনি- কিছুটা দ্বিধা কি থাকে না তাদের প্রতি? কিছুটা দ্বিধা কাজ করে নিজেও ক্ষেত্রেও। তাই তো শহীদুল জহিরের জগৎকে আমাদের আপন মনে হয়, চেনা মনে হয়, মনে হয় নিজের মুখের দিকেই তাকিয়ে আছি। সেই সঙ্গে আরও একটি কথা। এই যে সংশয়, দোলাচল। কোথাও কোথাও কি আমাদের জীবনানন্দ দাশকে মনে করিয়ে দেয় না?
শহীদুল জহিরের গল্প উপন্যাসের পাত্র-পাত্রী কারা? তারা কি লাতিন আমেরিকার জাদুবাস্তবতার সঙ্গে আমদানিকৃত? নাকি এ দেশের পোশাক পরা পাত্র-পাত্রী ভিনদেশি? নাকি একান্তই দেশীয়? তিনি কোন দেশের কথা বলেছেন? কোন সময়ের কথা বলেছেন?
এসব প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, তিনি এই দেশের মানুষের কথাই বলেছেন। এই সময়ের কথাই লিখেছেন। ‘পারাপার’ বইয়ের চরিত্রগুলো রিকশাওয়ালা, ঠেলাগাড়িওয়ালা, সুইপার, কুলিদের নিয়ে গড়ে উঠেছে। ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য’ বইতে পাই পুরান ঢাকার মানুষদের। কোনো কোনো গল্পে গ্রামের মানুষজনও উঠে এসেছে। যেমন ‘কার্তিকের হিমে, জ্যোৎস্নায়’ গল্পের ফৈজু।
তিনি সমকালীনতাকেই তার গল্পে তুলে এনেছেন। গল্প, উপন্যাসে মহান মুক্তিযুদ্ধকেও তুলে ধরেছেন। অর্থাৎ তিনি যা দিয়েই নিজের সাহিত্য-ভাবনাকে পুষ্ট করুক না কেন, তার পা এই দেশের মাটিতেই ছিল।
মনে রাখতে হবে, শহীদুল জহিরের গল্পে যেমন রয়েছে মার্কসীয় প্রভাব, তেমনই এখানে পাওয়া যাবে প্রাচ্য দেশীয় সংস্কৃতি ও দার্শনিকতা। পূর্বেই বলেছি, তিনি এমনভাবে তার জগৎ নির্মাণ করেছেন, যা পাঠককে গ্রাস করে ফেলে। ফলত, তার লেখা পড়ার পর কেউ কিছু লিখতে গেলে, সেখানে জহিরীয় ছায়া এসে পড়ে। কেউ কেউ সেই ছায়ায় জিড়োতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলে, কেউ কেউ খুঁজে নেয় নতুন পথ। শহীদুল জহিরের পরবর্তী প্রজন্মের অনেক কথাসাহিত্যিকের মধ্যেই সেই ছায়া কোথাও না কোথাও দেখা যায়। অনাগত কোনো গবেষক হয়তো তা একদিন প্রমাণসহ ভাবী কালের পাঠক, সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য রেখে যাবেন।
সময়ের আলো/জেডআই