প্রকাশ: রোববার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ৬:৫৫ এএম | অনলাইন সংস্করণ Count : 287
নিউক্লিয়ার ফিশান বা বিভাজন বিক্রিয়া প্রযুক্তিতে তৈরি বিধ্বংসী নিউক্লিয়ার বোমার কথা আমরা সবাই জানি। আর ঠিক এর বিপরীত বিক্রিয়া নিউক্লিয়ার ফিউশন বা নতুন যৌগ তৈরির মাধ্যমে সৌরশক্তি উৎপন্নের কথা এত দিন তত্ত্বগত বিষয় হলেও এখন তা বাস্তবে কার্যকর করার জন্য প্রয়াস চালাচ্ছে এক দল গবেষক। অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ওয়েলসের শিক্ষার্থীরা নিতে যাচ্ছে এই অভিনব উদ্যোগ। বিশ্বে প্রথমবারের মতো নিউক্লিয়ার ফিউশন ডিভাইস তৈরি করতে যাচ্ছে তারা। নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া সংঘটনের জন্য প্রয়োজনীয় উচ্চ মাত্রার তাপ তৈরির উদ্দেশ্যে ‘টোকামাক’ নামক একটি ডিভাইস নির্মাণ ও পরিচালনা করবে শিক্ষার্থীদের একটি দল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভার্টিক্যালি ইন্টিগ্রেটেড প্রজেক্টস (ভিআইপি) স্কিমের অংশ হিসেবে এই প্রকল্পটির পরিকল্পনা করা হয়েছে। অধ্যাপক ড প্যাট্রিক বুরের নেতৃত্বে টোকামাক ডিভাইসটি নির্মাণ ও পরিচালনা করবে শিক্ষার্থীরা। তবে ডিভাইসটিতে কোনো ধরনের পারমাণবিক জ্বালানি ব্যবহার বা এর দ্বারা কোনো ফিউশন বিক্রিয়া ঘটানো হবে না বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
বিগত কয়েক দশক ধরেই নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস খুঁজে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি ও তাপ উৎপাদনের চেষ্টা করছেন তারা। ফিউশন বিক্রিয়ায় কার্বন নির্গমন বা কোনো তেজস্ক্রিয় বর্জ্য তৈরি হয় না বলে এটিকে অনেক বেশি নিরাপদ বলে মনে করা হয়। পৃথিবীতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নিউক্লিয়ার ফিউশন ঘটানোর মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব উপায়ে অসীম পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব। সম্ভাব্য ক্লিন এনার্জি এবং শক্তিশালী শক্তির উৎস হিসেবে নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা তাই বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃত্রিমভাবে তাপ ও চাপ উৎপাদনের জন্য উচ্চ ক্ষমতার লেজার এবং টোকামাক চুল্লি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে বর্তমানে। সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই প্রকল্পের অধীনে ৩ ফুট বাই ৩ ফুট আকারের একটি টোকামাক ডিভাইস নির্মাণ করবে। টোকামাক এক ধরনের শক্তিশালী চুম্বকবিশিষ্ট ডোনাট আকৃতির ভ্যাকুয়াম, যার সাহায্যে উত্তপ্ত হাইড্রোজেন পরমাণুকে অত্যন্ত উচ্চ তাপমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করে ফিউশন বিক্রিয়া ঘটানো সম্ভব।
প্রসঙ্গত, যখন কোনো বিক্রিয়ায় কোনো মৌলের নিউক্লিয়াসে পরিবর্তন ঘটে তাকে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া বলে। এই বিক্রিয়া দুই ধরনের হতে পারে, নিউক্লিয়ার ফিউশন ও নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়া। যে নিউক্লিয়ার প্রক্রিয়ায় কোনো বড় এবং ভারী মৌলের নিউক্লিয়াস ভেঙে ছোট ছোট মৌলের নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়, তাকে নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়া বলে। নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া ঠিক এর উল্টো। যখন কোনো নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় ছোট ছোট নিউক্লিয়াস একত্র হয়ে অন্য কোনো মৌলের বড় নিউক্লিয়াস গঠন করে তাকে বলা হয় নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া। এই বিক্রিয়ায় হালকা গ্যাসগুলোর পরমাণুকে বিক্রিয়া সক্ষম করাতে এদের কয়েক মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উত্তপ্ত করতে হয়। একেকটি ফিউশন বিক্রিয়া শেষে প্রচুর পরিমাণে তাপশক্তি উৎপন্ন হয়। উৎপাদিত শক্তি দিয়ে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস এবং মেশিন ব্যবহার করা যায়।
আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র সূর্যে ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমেই তাপ ও আলোক শক্তি উৎপন্ন হয়। সূর্য ৭০ শতাংশ হাইড্রোজেন এবং ২৮ শতাংশ হিলিয়াম গ্যাস দিয়ে ভরা। নিজ অক্ষের চারিদিকে প্রবল গতিবেগে ঘোরার পাশাপাশি সমস্ত সৌরজগৎ নিয়ে সেকেন্ডে ১৯.২ কিলোমিটার বেগে মহাশূন্যের ভেতর দিয়ে ভ্রমণ করে সূর্য। এই সময় মহাকর্ষ টানের ফলে সূর্যের ভেতর থাকা গ্যাস-কণিকাগুলো প্রবল বেগে ছোটাছুটি করতে থাকে। কণিকাগুলো একে অপরের সঙ্গে ঘর্ষণের ফলে কয়েক মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াস উত্তাপের সৃষ্টি হয়। এই উত্তাপের ফলেই সরল ও হালকা হাইড্রোজেন পরমাণুগুলো বিক্রিয়া শুরু করে। চারটি হাইড্রোজেন পরমাণু মিলে একটি হিলিয়াম পরমাণু এবং বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়। এভাবেই প্রতিনিয়ত ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস একীভূত হয়ে হিলিয়াম নিউক্লিয়াসে রূপান্তরিত হয়ে চলেছে সূর্যের ভেতর। এই নিউক্লিয় রূপান্তর প্রক্রিয়ার সময় কিছু হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম হারিয়ে যায়। আইনস্টাইন তার বিখ্যাত সূত্র E=mc^2-এর মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে এই হারিয়ে যাওয়া ভর শক্তিতে রূপান্তর হয়। এক কিলোগ্রাম হাইড্রোজেন ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে রূপান্তর হয়ে ৯৯২ গ্রাম হিলিয়াম তৈরি করে। বাকি ৮ গ্রাম বস্তু রূপান্তরিত হয় শক্তিতে, যা আলো ও তাপরূপে আমরা পেয়ে থাকি। শুধু সূর্যই নয়, মহাবিশ্বের প্রতিটি নক্ষত্রের ভেতরেই নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া চলমান।
কৃত্রিমভাবে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া ঘটানোর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিক্রিয়ার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা। বিক্রিয়া সংঘটনের জন্য প্রচুর পরিমাণে তাপ ও চাপশক্তির যোগান দিতে হয়। এ ধরনের বিক্রিয়ায় নেট এনার্জি আউটপুট পেতে কমপক্ষে ১৫০-৩০০ মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন। ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জির লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো এই কৃতিত্ব অর্জন করতে সক্ষম হন। একটি নিউক্লিয়ার ফিউশন পরীক্ষায় ৭০০ কিলোজুল শক্তি উৎপাদন করতে পেরেছিলেন তারা।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক টোকামাক এনার্জি এবং অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি এইচবি-১১ এনার্জি কোম্পানি যৌথভাবে সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়কে এই প্রকল্প পরিচালনায় পৃষ্ঠপোষকতা করবে। শুধু ডিভাইসটি নির্মাণই নয়, এতে টানা কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক দিন কীভাবে তাপমাত্রা উৎপন্ন ও ধরে রাখা যেতে পারে, সে বিষয়েও গবেষণা করে দেখবে শিক্ষার্থীরা। এই গবেষণাটি তাই ফিউশন বিক্রিয়া গবেষণা ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীদের নানামুখী দক্ষতা বিকাশেও এই প্রকল্প সাহায্য করবে বলে মনে করেন অধ্যাপক ড. বুর, ‘এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে, পৃষ্ঠপোষকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে এবং একই সঙ্গে ফিউশন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে’।
শুধু ডিভাইসটি উদ্ভাবনই নয়, এর সামাজিক প্রভাবও বিশ্লেষণ করবে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক বুর বলেন, ‘এটি একটি ক্রস-ফ্যাকাল্টি প্রকল্প। আমাদের ভিআইপি শিক্ষার্থীরা ছাড়াও সামাজিক বিজ্ঞান এবং কলা অনুষদের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা এতে অংশ নেবে। ফিউশন প্রযুক্তি সম্পর্কে জনসাধারণের প্রাথমিক জ্ঞান ও উপলব্ধি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবে তারা। এরপর উদ্ভাবিত প্রযুক্তিকে কীভাবে সমাজের সঙ্গে কার্যকরীভাবে যুক্ত করা যায়, সেই উপায়গুলো অনুসন্ধান করবে’।
প্রকল্পটি সফল হলে এই প্রযুক্তি নিরাপদ অবকাঠামো নির্মাণ, পরিবহন ব্যবস্থা এবং মহাকাশে প্রয়োগ করা হতে পারে। আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেই টোকামাক ডিভাইসটি নির্মাণ সম্ভব বলে আশা করছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। ভবিষ্যতে উচ্চ ক্ষমতার লেজার নিয়েও কাজ করার পরিকল্পনা করছে তারা।
/আরএ