দরজায় কড়া নাড়ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনকে কেন্দ্রকরে রাজনীতিবিদরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। নিজের নির্বাচনি এলাকায় জনসংযোগ করছেন। সাধারণ মানুষও প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। চায়ের দোকানে হাটে মাঠে ঘাটে জমে ওঠেছে নির্বাচনি আড্ডা। কোন ফরমেটে কার তত্ত্বাবধানে নির্বাচন হবে তা নিয়ে সাধারণ ভোটারদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। নির্বাচন আসছে, ভোট দিতে পারবে এতেই তারা আনন্দিত।
বাংলাদেশের মানুষ রাজনীতি সচেতন। তারা প্রকৃতিগত ভাবেই সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব। রাজনীতি এ দেশের মানুষের রক্তে সতত প্রবহমান। ইতিবাচক রাজনীতি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষই পছন্দ করে।
১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাংলা বিহার ওড়িশার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের পর এ দেশের মানুষ মীরজাফর ও ঘসিটি বেগমদের আসল রূপ উন্মোচন করে। ইতিহাসের নির্মমতা থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষ সামনে পথ চলতে থাকে। শুরু হয় তাদের বিজয়ের পথে যাত্রা।
বাংলার মানুষ নিজ মাতৃভূমি থেকে ব্রিটিশদের বিতাড়িত করে। সূর্যসেন-প্রীতিলতাদের গর্জে ওঠার মধ্য দিয়ে শুরু হয় নতুন দিন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর বাঙালি জাতি আর পেছন ফিরে তাকায়নি।
বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা কর্মসূচি, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পথ ধরে আসে ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা আন্দোলন, রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। দীর্ঘ ৯ মাস অবিরাম রক্ত ঝরানোর পর আসে মহান বিজয়। বীরের জাতি বাঙালি অর্জন করে মহা বিজয়। বাংলার সর্বত্র পতপত করে উড়তে থাকে লাল-সবুজ পতাকা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহানায়ক হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ ও এ দেশের মানুষকে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করতে থাকেন। তাঁর দূরদর্শী চিন্তা ও গতিশীল নেতৃত্বে সামনে এগোতে থাকে বাংলাদেশ। বিজয়ের স্বাদ উপভোগ করতে থাকে বাঙালি জাতি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করে ঘাতকরা। ঘাতক মোশতাক গংয়ের দাপটে কলঙ্কিত হয় গোটা দেশ। চলতে থাকে তাদের দৌরাত্ম্য। নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও উত্থান-পতনের মাঝ দিয়ে ক্ষমতায় আসে স্বৈরশাসক এরশাদ। ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানের মুখে পতন হয় স্বৈরশাসকের। এর পরের ইতিহাসও খুব একটা সুখকর ছিল না। জঙ্গিবাদের দৌরাত্ম্যে দেশ পরিণত হতে যাচ্ছিল একটা জঙ্গি রাষ্ট্রে। বাংলা ভাই, শায়খ আবদুর রহমান, মুফতি হান্নানদের কবলে পড়েছিল স্বাধীন-সার্বভৌম সোনার বাংলা।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবার ক্ষমতায় এসেই শুরু করেন জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযান। শতভাগ না হলেও বলা যায় নব্বই-পঁচানব্বই ভাগ সফল হন জঙ্গি দমনে। বর্তমানে বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা নেই বললেই চলে। তারপরও জঙ্গির ব্যাপারে সদা সতর্ক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সামনের নির্বাচনকে ঘিরে জঙ্গিরা যেন কোনো তৎপরতা চালাতে না পারে সে ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন বিভিন্ন সংস্থা।
বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে নজর পৃথিবীর বড় বড় দেশের। বলা যায় বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ধারণ হবে নির্বাচনের মাধ্যমে। বাংলাদেশের মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের প্রস্তুতি নিচ্ছে। নেতাকর্মীরা দৌড়ঝাঁপ করছে। মানুষের দোয়ারে দোয়ারে ভোট প্রার্থনা করছে। ভোটারদের খুব গুরুত্ব দিচ্ছে।
বাংলাদেশের অনেক ভোটারের শিক্ষাদীক্ষা কম হলেও দেশ-বিদেশের সব খবর তাদের নখদর্পণে । চায়ের দোকানে বাসে ট্রাকে হাটে মাঠে ঘাটে তারা রাজনীতি চর্চা করে। রাজনৈতিক অনেক ঘটনা নিয়ে তারা বিচার-বিশ্লেষণ, আলোচনা-সমালোচনা পর্যালোচনা করে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটারদের উচ্ছ্বাস যতটা বাড়বে ঠিক ততটাই গ্রহণযোগ্যতা পাবে নির্বাচন। নির্বাচনের মাঠ যত গরম হবে ঠিক ততই প্রাণ ফিরে পাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে যা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাংলার মানুষ জেগে উঠছে। নির্বাচনের দিকে ঝুঁকছে। বিষয়টাকে ইতিবাচকভাবে দেখছে বিশ্ববাসী।
একটা অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য দরকার সাধারণ ভোটারদের সম্পৃক্ততা ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নেওয়ার জন্য আগ থেকেই পরিবেশ তৈরি করতে হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলগুলো পরিবেশ তৈরির কাজটিই করছে। সম্ভাব্য প্রার্থীরা ভোটারদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে দোয়া ও ভোট প্রার্থনা করছে। নানারকম জনসংযোগ করছে।
কোনো কোনো সম্ভাব্য প্রার্থী সপ্তাহ কিংবা মাসের বেশিরভাগ সময়ই কাটাচ্ছেন নিজ নির্বাচনি এলাকায়। কেউ কেউ নানারকম সমাজসেবামূলক কাজও করছেন। হাই কমান্ডের নির্দেশে অনেক কেন্দ্রীয় নেতা দেশের আনাচে-কানাচে চষে বেড়াচ্ছেন। সব মিলে একটা নির্বাচনি আমেজ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে। অধিকাংশ আসনেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস দিচ্ছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা।
ভারত আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশও বাংলাদেশে একটা অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রত্যাশা করছে। সে প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটাতে সব রকম ব্যবস্থা করছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের মূল কাজ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। সব সংস্থার সার্বিক সহযোগিতায় এই কাজটি সম্পন্ন করে নির্বাচন কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলোকেও সহযোগিতার হাত বাড়াতে হয়। বিগত দিনগুলোতে সহযোগিতার হাত বাড়ানোর কাজটি করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। এরই ধারাবাহিকতটা প্রত্যাশা করছে নির্বাচন কমিশন।
পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনগুলোতে ইতিমধ্যে নির্বাচনি আমেজ শুরু হয়েছে। টেলিভিশন টকশোতে নির্বাচনের নানা দিক নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা হচ্ছে। সামনে এই আলোচনা আরও বাড়বে। এবারের নির্বাচনি প্রচারণায় সবাই বিগত দিনে যার যার কার্যক্রম তুলে ধরছে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা তাদের উন্নয়নের ফিরিস্তি জনসম্মুখে তুলে ধরছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, টানেল, এলিভেটেডে এক্সপ্রেসওয়েসহ সব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা জোরেশোরে প্রচার করছে। সামনে আরও কী কী মেগা প্রকল্প আসছে তার কথাও বলছে দাপটের সঙ্গে।
প্রতিটি রাজনৈতিক দলই তাদের নির্বাচনি ইশতহারে সম্ভাব্য যা যা থাকতে পারে তা সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থাপন করছে। সবাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় তুলছে। নির্বাচন পর্যন্ত চলবে এই ঝড়ের তাণ্ডব।
কদিন আগেও বলা যায় নির্বাচনি প্রচারণা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল রাজনৈতিক দলগুলো। এখন সেই দ্বিধাটা আর নেই।
আস্তে আস্তে জলের স্বচ্ছ ধারা প্রবাহিত হতে শুরু করেছে। জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন, ব্রিকস সম্মেলন- উভয়ই বাংলাদেশের নির্বাচনের ব্যাপারে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যে অতুলনীয় সম্মান দেখিয়েছেন বিশ্বনেতারা তাতে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষ আনন্দিত গর্বিত ও কৃতার্থ। শেখ হাসিনা যেভাবে বিশ্বনেতার মর্যাদা পেয়েছেন সেভাবেই সামনে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ ও এ দেশের মানুষ।
আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বিশ^নেতাদের মাঝেও একটা ইতিবাচক মনোভাব পরিলক্ষিত হয়েছে যা বাংলাদেশের জন্য সত্যিই সুখবর। বলা যায় বিশ^কূটনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ ইতিবাচক। এই ইতিবাচক দিকটা বিরাজমান অবস্থায় বাংলাদেশে ভোট হলে সর্বজনগ্রাহ্য একটা নির্বাচন হবে বলে আশা করছেন বিশেষজ্ঞরা। নির্বাচন কমিশনও এ ব্যাপারে বেশ আশাবাদী।
সারা দেশের মানুষ যে নির্বাচনের ব্যাপারে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সে নির্বাচনের ভিতটা মজবুত হওয়া জরুরি। আর এই জরুরি বিষয়টারই গ্রাউন্ড তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
রাজনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রেখে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। নির্বাচন পর্যন্ত তারা এভাবেই চালাবে। নির্বাচনের ব্যাপারে দেশের মানুষ আশাবাদী।
দেশি-বিদেশি অনেক গবেষকই বিষয়টি নিয়ে চালাচ্ছে তাদের গবেষণাকর্ম। আশা করা যায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু সর্বজনগ্রহণযোগ্য ও সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটবে। স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।