প্রতিদিন বাড়ছে মানুষ। প্রতিদিন যেন মানুষের ঢল আসছে রাজধানী ঢাকাতে। কিছু একটা পাওয়ার আশায়। তাই অন্য শহরের চেয়ে ঢাকায় জনসংখ্যা বাড়ছে খুব বেশি, কিছু জন্মসূত্রে আর কিছু অন্য শহর থেকে আসছে। গ্রাম থেকেও দলে দলে মানুষ আছে ঢাকায়। প্রতিদিন ঢাকার বাসিন্দা হিসেবে যোগ হচ্ছে প্রায় ১ হাজার ৭০০ জন।
তা ছাড়া সরকারি অফিস-আদালত, সেরা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংকের হেড অফিস, ভারী ও মাঝারি শিল্প কারখানাসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা কেন্দ্রীভূত হওয়ায় ঢাকায় আসা ছাড়া কিছু মানুষের সামনে কোনো বিকল্প পথ নেই। এ ছাড়া অনেক শিল্প-কলকারখানা রাজধানী এবং এর আশপাশে হওয়ায় বিশাল জনগোষ্ঠীর বাস রাজধানী ও সংলগ্ন এলাকায়, যার বিশাল প্রভাব পড়ছে বৃহত্তর ঢাকায়।
আমরা জানি, দেশের সব ধরনের সেবা রাজধানীকেন্দ্রিক, তাই মানুষও ভিড় জমাচ্ছে ঢাকায়। শিক্ষার অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, হাইকোর্ট, আবহাওয়া অধিদফতর, বন ভবন, খাদ্য ভবন, পানি ভবনসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় ঢাকায়।
এর ফলে যত দিন যাচ্ছে, শহরের পরিবেশ ততই খারাপ হচ্ছে। যদি ১৫-২০ বছর আগের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তা এখনকার চেয়ে পরিবেশ ভালো ছিল। এর কারণ ভাগ করা এবং ভালো থাকার যত আয়োজন। কিন্তু সেভাবে কি ভালো থাকা হচ্ছে?
ঢাকাকে নেওয়া হয়েছে জিডিপির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে। এখানে নতুন নতুন আবাসিক প্রকল্প, শিল্প ও ব্যবসাকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু তা করতে গিয়ে যে পরিবেশকে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে, জলাভূমিগুলো ভরাট করে উন্নয়ন করা হচ্ছে, সবুজ গাছপালা উজাড় করে উন্নয়ন করা হচ্ছে, এমনকি শহর সম্প্রসারণ করতে গিয়েও পরিবেশকে ধ্বংস কর হচ্ছে, তা কারও খেয়ালে নেই। ঢাকায় নতুন নতুন যেসব আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠেছে, সেখানে ন্যূনতম পরিবেশের মানদ- রক্ষা করা হয় না।
ঐতিহ্যের শহর, প্রাচীন শহর এখন তার সৌন্দর্য হারাতে বসেছে। এখনই ভাবার সময় এসেছে কীভাবে ঢাকাকে বাঁচানো যায়, ঢাকামুখী ক্রমবর্ধমান জনস্রোত ঠেকাতে না পারলে এই শহরকে বাঁচানো যাবে না। ঢাকা শহরে মানুষ আসে কর্মসংস্থানের আশায়। যদি ঢাকার বাইরে কর্মসংস্থান হতো, তা হলে ঢাকার বাইরের মানুষ ঢাকায় আসত না, এমনিতেই জনস্রোত থেমে যেত। পদ্মা সেতু হয়েছে, যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু হয়েছে। কিন্তু এই দুই সেতুর ওপারে শিল্পায়নের কথা ভাবা হয়নি। সেখানে শিল্প কারখানা গড়ে উঠলে মানুষ কাজের সন্ধানে সেখানেই যেত। ঢাকায় ভিড় করত না। পদ্মা সেতু হওয়ার পর ঢাকা-মাওয়ার মধ্যবর্তী স্থানেও বড় বড় আবাসিক প্রকল্প গড়ে উঠেছে। যার লক্ষ্য এই ঢাকা শহর। দেশের উত্তরাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে শিল্প কারখানা গড়ে তুলতে হবে। ঢাকায় একটা মেট্রোরেল হয়েছে, এরপর হয়তো আরও পাঁচটা হবে। কিন্তু এসব মেগা প্রকল্প করে ঢাকাকে বাঁচানো যাবে না। মেগা প্রকল্পের জন্য এ শহর দেশের জন্য বোঝা হয়ে যাবে। যেভাবেই হোক ঢাকামুখী কর্মসংস্থান বাইরে নিয়ে যেতে হবে। তুরাগ ও কেরানীগঞ্জ প্রকল্প করলে হবে না।
উন্নয়ন বিকেন্দ্রীকরণের প্রথম শর্ত হলো প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ। আমাদের অনেক মন্ত্রণালয় আছে, যেগুলোর প্রধান কার্যালয় ঢাকায় থাকার প্রয়োজন নেই। যেমন-
কৃষি, প্রাণিসম্পদ, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়। হাওর উন্নয়ন বোর্ড বা পানি উন্নয়ন বোর্ড ঢাকায় না থাকলেও চলে। এসব মন্ত্রণালয় ঢাকার বাইরে নেওয়া দরকার, তাই এখন দরকার প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ। এখনই যদি কাজগুলো না হয় তা হলে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ হবে না। যানজট এবং পরিবেশ দূষণের কারণে অনেকেই এখন ঢাকায় থাকতে চায় না। যদি বিভাগ ও অন্য জেলাগুলোতে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা হয় মানুষ সানন্দে ঢাকা থেকে স্থানান্তরিত হবে। এতে এ নগরীতে ধীরে ধীরে যানজট কমবে, পরিবেশ দূষণের কারণগুলো দূর হবে, এ শহর বাসযোগ্যতা ফিরে পাবে।
মাত্র ৫০ বছর আগেও ঢাকা নগরী ছিল একটি সবুজ জনপদ, অন্য শহর থেকে এসে মানুষ মুগ্ধ হয়ে দেখত। অথচ কিছু দিনের ব্যবধানে এ শহর কংক্রিটের নগরীতে পরিণত হয়েছে। সঙ্গে বাড়ছে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ এবং জলদূষণও।
বিশ্বের অন্যতম নোংরা নগরী হিসেবে ঢাকার পরিচিতি কিছুতেই হটানো যাচ্ছে না। বলা যায়, সিটি করপোরেশনের সেবাতে ঢাকা এখন মশামাছি মুক্ত হয়েছে। কিন্তু এখন ঢাকা বিশ্বের শীর্ষ যানজটের নগরীগুলোর একটি। ফুটপাথেও নেই হাঁটার পরিবেশ। দূষণ ও অস্বস্তিকর জীবনের কারণে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে। জনসংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে চিকিৎসাসেবার জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়।
ঢাকার নাগরিক পরিষেবা খুবই দুর্বল। আমরা জানি, ঢাকার যানজট, বৃষ্টি হলে জলজট প্রধান সমস্যা, কোথাও কোথাও বিদ্যুৎও থাকছে না। কখনো কখনো গ্যাসও থাকে না।
এ ছাড়াও ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো শিক্ষাব্যবস্থা বা বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা। নিজ এলাকায় মানসম্মত স্কুল না থাকায় সন্তানকে দূরের এলাকার স্কুলে ভর্তি করাতে হয়। ফলে সন্তানকে নিয়ে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় অভিভাবকদের ছোটাছুটি করতে হয়। এতে যানজটের কবলে পড়ে অর্থ ও সময়ের অপচয় হয়।
বিদ্যালয় হতে হবে বাড়ির কাছে, বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে যে শহর সাজাতে হবে, তাতে শিশুটি নিরাপদ থাকবে, বাঁচবে সময় বাঁচবে অর্থ, শহর থাকবে যানজটমুক্ত।
আর এখন ঢাকা বলা হচ্ছে বসবাসের অযোগ্য নগরী, ইট-কংক্রিটের বস্তি। এ ধরনের নানা অনাকাক্সিক্ষত অভিধা সত্ত্বেও ঢাকার জনসংখ্যা হুহু করে বাড়ছে। কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না ঢাকামুখী জনস্রোতকে। বসবাসের অযোগ্য নগরী হওয়া সত্ত্বেও পেটের দায়ে মানুষ ঢাকামুখী হচ্ছে।
কর্মসংস্থানের সিংহভাগ সুযোগ ঢাকায় হওয়ায় বাধ্য হয়ে আসছে তারা। এ প্রবণতা ঠেকাতে হবে। রাজধানীর বাইরে কর্মসংস্থানের সব ধরনের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। শিল্প কারখানা স্থাপন করতে হবে দেশের প্রতিটি প্রান্তে। ছোট শহরগুলোতেও নাগরিক সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে। এ কাজটি করার সময় এখনই।
আমরা জানি, পরিকল্পিত নগর বলতে বোঝায় একটি পরিকল্পিত জনবসতি, যার সবকিছু হবে পরিকল্পনা অনুযায়ী। সুপরিকল্পনা ছাড়া কোনো শহরকে সুন্দর শহরে পরিণত করা যায় না। সবসময় রাজধানী শহর হতে হয় ভিক্ষুকমুক্ত, কিন্তু ঢাকার ক্ষেত্রে একদমই বিপরীত। রাস্তায় বের হলে কখনো কখনো ঢাকাকে ভিক্ষুকের শহর বলে ভুল হতে পারে। এ শহরকে আদর্শ শহরে পরিণত করতে হলে সবার আগে ভিক্ষুকমুক্ত করতে হবে, যেন কোনো রাস্তার মোড়ে ভিক্ষুক দ্বারা কোনো প্রকার অবাঞ্ছিত ঘটনা না ঘটে। তাদের অন্য শহরে নিয়ে বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
ঢাকা শহরকে সুন্দর শহরে পরিণত করার জন্য সবুজের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য প্রচুর বৃক্ষরোপণ করতে হবে। প্রতিটি এলাকায় থাকতে হবে খেলার মাঠ, থাকতে হবে জলাশয়, থাকতে হবে পার্ক। এ জন্যও দরকার সঠিক পরিকল্পনা। ঢাকা শহরকে সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে হবে।
তবে এর সঙ্গে মনে রাখা দরকার, শুধু ঢাকা শহরের উন্নয়ন করলে হবে না। ঢাকার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অন্যান্য শহরকেও পরিকল্পিত নগরে পরিণত করতে হবে। সেসব শহরে থাকতে হবে সঠিক কর্মসংস্থান। সুপরিকল্পিত বাসস্থান ব্যবস্থা। সঠিক শিক্ষাব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যসেবা। জীবনযাপনের জন্য আধুনিক সব ধরনের ব্যবস্থা থাকলে মানুষ সেসব শহরে আনন্দে বসবাস করবে। ঢাকায় স্থায়ী হওয়ার কথা ভাববে না।
একই সঙ্গে গ্রামকেও উন্নত করতে হবে। মনে রাখা দরকার, চৌষট্টি হাজার গ্রাম বাঁচলে দেশ বাঁচবে। আমরা জানি, গ্রাম থেকে আসছে সারা দেশের খাদ্যের সংস্থান। তাই গ্রামে থাকতে হবে সঠিক শিক্ষাব্যবস্থা অর্থাৎ স্কুল-কলেজ এবং চিকিৎসাব্যবস্থাও নিয়ে যেতে হবে গ্রামের মানুষের দোরগোড়ায়।
গ্রামের মানুষের মধ্যে পুষ্টি বিষয়ে জ্ঞান দিতে হবে, শিক্ষিত করে তুলতে হবে গ্রামের নারীদেরও। কারণ একজন শিক্ষিত মা পারে একটি শিক্ষিত জাতি গড়ে তুলতে। শহরের মতো সুষম উন্নয়ন করতে হবে গ্রামেও। শহরের ওপর জনসংখ্যার চাপ কমাতে এই উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। এভাবে যদি সঠিক পরিকল্পনার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাওয়া যায় তা হলে রাজধানী ঢাকা হবে প্রকৃতই তিলোত্তমা নগরী। আমাদের প্রিয় শহর হয়ে উঠবে বিশ্বের একটি আদর্শ শহর।
কবি ও কথাসাহিত্যিক
সময়ের আলো/আরএস/