বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার সুনিপুণ-সফল নেতৃতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশব্যাপী অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, বিশেষ করে বিগত এক যুগে বাংলাদেশের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। এই ধারাবাহিকতায় একবিংশ শতাব্দীর আলোর যুগে প্রবেশ করেছে বাংলা জনপদ। বিশ্বব্যাপী বর্তমানে যে ‘স্মার্ট রেভল্যুশন’ চলছে, তার বড় অংশীদার শেখ হাসিনার বাংলাদেশ।
আমরা দেখেছি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় কাউন্সিলের উদ্বোধনী ভাষণে (২৪ ডিসেম্বর ২০২২) ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১ রূপকল্প’ ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠে আমরা পুনর্ব্যক্ত হতে দেখেছি তার চলতি মেয়াদের চার বছর পূর্তি উপলক্ষে ৬ জানুয়ারি ২০২৩ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্মার্ট বিশ্বের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলেছি আমরা। শেখ হাসিনার প্রশাসনের চোখ দিয়ে আমরা এমন এক স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, যাতে করে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেক দূর এগিয়ে যাবে বর্তমান ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’। ডিজিটাল প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো হাতিয়ার ব্যবহার করে দেশের কর্মক্ষেত্রও প্রসারিত হবে বেশ খানিকটা। এসব করতে তথা কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে যথেষ্ট প্রস্তুতি থাকা চাই-এ কথা মাথায় রেখেই নীতি ও কর্মপন্থা সাজিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
স্মার্ট ও উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে নতুন অর্থবছরের বাজেটে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে। পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের ১৩ দশমিক ৭০ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে এ খাতের জন্য। স্মার্ট ও উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে শিক্ষা ও প্রযুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। যে দেশ যত বেশি শিক্ষা ও প্রযুক্তির দিক থেকে এগিয়ে, সে দেশ তত বেশি উন্নত ও সমৃদ্ধ। বাজেটের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ব্যয় করা হলে বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে অনেক গবেষণা হবে। এর ফলে অনেক ভালো মানের শিক্ষক, গবেষক এবং বিজ্ঞানী তৈরি হবে, যাদের মেধাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে একটি স্মার্ট ও উন্নত দেশে পরিণত হবে।
প্রযুক্তিবিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে, বিশেষ করে চ্যাটজিপিটির ব্যবহার শুরু হলে এ নিয়ে যেন আলোচনা থামছেই না। যদিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ডিজিটাল ইকোসিস্টেমের অংশ বেশ কিছুদিন ধরেই। গুগল, অ্যাপেল, মাইক্রোসফট, অ্যামাজন, টেসলা ও আলিবাবার মতো বড় কোম্পানিগুলো বেশ কিছুদিন ধরে জোরেশোরেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করছে। চ্যাটজিপিটি যেমন একটি সার্চইঞ্জিন বট যে কিনা শুধু তথ্য খুঁজতেই দক্ষ নয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আলোকে তথ্যের প্যাটার্নও তৈরি করতে পারে, এটাই এখন বিরাট বিস্ময় সৃষ্টি করছে এবং সংবাদমাধ্যমে একের পর এক খবরের জোগান দিচ্ছে। একইভাবে আমরা অন্য বট প্রোগ্রামের কথা জানি বিশেষ করে করোনার সময় বিভিন্ন সেবা গ্রহণে বট ব্যবস্থার সঙ্গে বেশ ভালোভাবেই পরিচিত হই। আবার গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট সবার সঙ্গে ভাষার মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারে এবং চাহিদার ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় তথ্য মুহূর্তের মধ্যে হাজির করে। আবার আমাদের মধ্যে কে কে গুগল অনুবাদের ব্যবহার করেছি, এক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা কেমন?
ভার্চুয়াল জগৎ এখন মানব-সংস্কৃতির অংশ যদিও আমাদের ডিজিটাল সংস্কৃতিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় সাধারণভাবে সরকারি দু’একটি ফর্ম ডাউনলোড করা, অডিও ও ভিডিও কল করা, ফেসবুকের ব্যবহার, প্রকাশনা, ওয়েবসাইট তৈরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রচার ও প্রসারের জন্য ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার এবং ই-কমার্সের কিছুটা হলেও প্রচলন শুরু হয়েছে।
কিন্তু পৃথিবীর অর্থনৈতিক কাঠামো যেদিকে এগুচ্ছে তাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তারই জয়জয়কার এবং চলছে বাজার ধরার প্রতিযোগিতা। পৃথিবীতে ডিজিটাল প্রযুক্তি অতিদ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে আর এই পরিবর্তন হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে। বলা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংবলিত স্বচালিত গাড়ির বাজার হবে ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং স্বচালিত ড্রোনের বাজার হবে ৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যদিও আমাদের দেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে এক ধরনের চাপা আতঙ্ক আছে।
অনেকেই মনে করছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মনে হয় মানুষের বিকল্প হতে যাচ্ছে কিন্তু বাস্তবে মোটেও তা নয়। বরং এটি মেশিন লার্নিং, তথ্য বিশ্লেষণ ও ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা এবং ভাষার ব্যবহারের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় এটি মানুষের আচরণ অনুকরণ করতে পারে এবং মানুষের জন্য কষ্টসাধ্য ও বারবার করতে হয় এমন কাজে সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠে। তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ধীরে ধীরে নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে পারে এবং কোনো ধরনের তাৎক্ষণিক নির্দেশনা ছড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও সেবা দিয়ে থাকে।
এই ভার্চুয়াল মাধ্যমকে কেন্দ্র করেই জীবনযাপন, যোগাযোগ, বাজারসদাই, লেনদেন, বিনোদন ইত্যাদি সবই চলছে। এই ভার্চুয়াল জগতে ক্রমেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আনাগোনা গভীর হচ্ছে। প্রযুক্তি ব্যবহারে মানুষের অভিজ্ঞতা আরও সমৃদ্ধ করছে। শুধু তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে নয়, মেশিন লার্নিং ও রোবটিকস প্রযুক্তি সহযোগে মানুষের জীবনযাপনের অভিজ্ঞতাকে পাল্টে দিচ্ছে। এসবই মানব ইতিহাসে এক নতুন সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছে এবং মানুষ সেখানেই ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। সেখানে ভার্চুয়াল জগৎও মাঝে মাঝে অস্থির হয়ে ওঠে ভার্চুয়াল অপরাধীদের দাপটে। না, ভার্চুয়াল অপরাধের সঙ্গে শুধু মানুষই নয়, এখানেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকেও ব্যবহার করা হয়।
ডিজিটাল সংস্কৃতি ও ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে মানুষের কর্মসংস্থানের ধরনের ক্ষেত্রে একটি বিরাট পরিবর্তন আসতে পারে। বারবার করতে হয় এমন কাজগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়বে। ফলে প্রচলিত এমন অনেক পেশা অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে। ভার্চুয়াল মার্কেটে এখন আর কোনো সেলস পারসন-এর কোনো প্রয়োজন নেই, বরং সেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংবলিত কোনো একটি বট কাজ করছে যে প্রতিনিয়ত ক্রেতার আলাদা আলাদা পছন্দ ও অপছন্দকে অনুসরণ করে এবং প্রত্যেককে কাস্টমাইজ সার্ভিস দিচ্ছে। একইভাবে দেখা যাচ্ছে, কলকারখানায় অনেক শ্রমিকের কাজ করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসংবলিত মাত্র একটি রোবট।
আমরা এখন বিশ্বায়নের যুগে বসবাস করছি। এই যুগে প্রযুক্তি যেভাবে সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করছে তা নিয়ে কোনো ভবিষ্যদ্বাণীই যেন কাজে লাগছে না। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েভ এখন শুধু তরঙ্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, এর সঙ্গে এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমন্বয় ঘটেছে, ভবিষ্যতে আর কী কী অপেক্ষা করছে তা বলা দুরূহ। বিশ্বায়নের কালে বিশ্বে ক্ষমতার কেন্দ্রিকতা নির্ভর করে বিশ^প্রযুক্তির ওপর কার কতটুকু নিয়ন্ত্রণ আছে তার ওপর।
এ অবস্থায় বিশ্বে আমাদের অবস্থান তৈরি নির্ভর করে নতুন নতুন প্রযুক্তি এবং এ সম্পর্কিত ইকোসিস্টেমে আমরা কতটুকু অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারছি তার ওপর। অধিকন্তু শুধু অভ্যস্ত হলেই হবে না, পাশাপাশি এই প্রযুক্তির ওপর কতটুকু নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও অন্যের নির্ভরশীলতা তৈরি করতে পেরেছি তার ওপর। ডিজিটাল বাংলাদেশের পর দেশকে এখন আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে তৈরি করতে চাই, আর এই স্মার্ট দেশ তৈরিতে স্মার্ট সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, চ্যাটজিপিটি যেভাবে দুনিয়াজুড়ে সাড়া ফেলেছে, তাতে এর সঙ্গে আরও নতুন নতুন প্রতিযোগী যুক্ত হচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সবক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন হবে সে বিষয় নিশ্চিত। আপনি কাউকে ভালোবাসেন, কিন্তু মনের কথা প্রাণ খুলে লিখতে পারেন না; সে চিঠিও নিখুঁতভাবে লিখে দেবে। আপনার গোপন প্রেমের কথা, হৃদয়ের ব্যথা জেনে যাবে। কেউ অপরাধ করেছে, তার তদন্ত ও শাস্তি কী হবে বা আদৌ কিছু হবে কিনা সব জানিয়ে দেবে এই কৃত্রিম রোবট।
তাহলে ভবিষ্যতের বর্তমান কেমন হবে? মানুষ হয়তো তার ক্ষমতা হারাবে নয়তো নতুন জগৎ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। চ্যাটজিপিটি তার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে মানুষের চেয়ে দ্রুত এবং সঠিক উত্তর প্রদান করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভাবনীয় অগ্রগতির ফসল চ্যাটজিপিটি। এর বিশেষত্ব হলো এটা মানুষের কথাবার্তা এমনভাবে নকল করে যে এর সঙ্গে চ্যাট করলে যন্ত্র মনে হবে না। ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকা সব ধরনের বিষয়ে চ্যাটজিপিটিকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কারণে এর ভাষাগত দক্ষতাসহ সবক্ষেত্রে আলোচনা চালিয়ে যেতে চ্যাটজিপিটি এখন সক্ষম। এর সৃজনশীলতা শুধু প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি আমাদের মতো গল্প, চিত্রনাট্য এমনকি জটিল সফটওয়্যারের কাজ করতে পারে। একে দিয়ে সীমাহীন কাজ করে নেওয়া এখন সম্ভব এবং বিভিন্ন ধরনের কাজ ইতিমধ্যে সে করে চলেছে।
চ্যাটজিপিটি বহু কাজে সফলতার পরিচয় দিলেও এখনও এটি সম্পূর্ণ নিখুঁত নয়। আমরা নিজেরা যেহেতু ভুল করছি ঠিক আমাদের মতো চ্যাটজিপিটি বেশ কিছু ভুল করছে। তবে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে চ্যাটজিপিটি নিজেকে সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত করছে। ফলে যত বেশি আমরা এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করব, চ্যাটজিপিটির সিস্টেম তত বেশি উন্নত হতে থাকবে।
প্রাবন্ধিক ও গবেষক
সময়ের আলো/আরএস/