স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরে (এলজিইডি) সড়ক মেরামতের নামে চলছে লুটপাটের মহোৎসব। লালমনিরহাটে পিচঢালা রাস্তাকে মাটির রাস্তা দেখিয়ে সংস্কারের নামে লোপাট করা হয়েছে দেড় কোটি টাকা। কাজ না করেই সংযোগ সড়ক মেরামতের নামে রংপুর বিভাগ উন্নয়ন প্রকল্প থেকে ঠিকাদারকে ৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
এ ছাড়া সড়কের দৈর্ঘ্যরে চেয়ে বেশি দৈর্ঘ্যরে সংস্কার দেখিয়ে ৪ কোটি টাকা লোপাট, অস্তিত্ববিহীন সড়ক নির্মাণ দেখিয়ে ৫ কোটি টাকা ব্যয় এবং একই সড়ক একাধিক প্রকল্পে সংস্কার দেখিয়েও অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। এলজিইডি কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন কার্যক্রমের ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের হিসাব সম্পর্কিত কমপ্লায়েন্স নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এসব অনিয়ম ধরা পড়েছে। প্রতিবেদনের সুপারিশের আলোকে এসব অনিয়মের বিষয়টি খতিয়ে দেখছে জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, এলজিইডির লালমনিরহাট নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় ২০১৯-২০ অর্থবছরে কোনো কাজ না করার পরও কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা শ্যামকরধা-মহিপুর-বুড়িহাট জেসি রোডের ৩টি কালভার্ট ও ২টি ব্রিজের সংযোগ সড়ক মেরামতের নামে রংপুর বিভাগ উন্নয়ন প্রকল্প থেকে ঠিকাদারকে ৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা বিল পরিশোধ করা হয়েছে। নিরীক্ষা দলের ২০২১ সালের ১৩ জানুয়ারি এলজিইডির কালীগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলীর উপস্থিতিতে বাস্তব যাচাইয়ে দেখা যায় যে, কালভার্ট ও ব্রিজের সংযোগ সড়কে মেরামত কাজের কোনো অস্তিত্বই নেই।
স্থানীয় বাসিন্দাদের মতামত অনুযায়ী বর্ণিত ৩টি কালভার্ট ও ২টি ব্রিজের সংযোগ সড়কে মেরামতের নামে সামান্য কিছু কাজ করা হয়েছে। প্রাক্কলন অনুযায়ী ব্রিজের সংযোগ সড়কের দুই পাশে মাটিভর্তি জিও ব্যাগ দেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে বালুভর্তি অল্পসংখ্যক বস্তা দেখা গেছে। এলজিইডি কর্তৃক ২০১৬ সালে ব্রিজগুলোর নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করার সময়ই রাস্তার সংযোগ সড়কের দুই পাশে সিসি ব্লক দেওয়া হয়।
মেরামতের নামে ২০১৯-২০ অর্থবছরে পুনরায় প্রাক্কলন দেখিয়ে সিসি ব্লকের কাজ দেখানো হলেও বাস্তবে নতুন কোনো সিসি ব্লক পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া বর্তমানে ব্রিজগুলোর সংযোগ সড়কের দুই পাশ ভেঙে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় আছে। এতে প্রমাণ হয় যে, প্রাক্কলন অনুযায়ী সংযোগ সড়ক মেরামতের নামে ৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হলেও বাস্তবে কোনো কাজ করা হয়নি। তা ছাড়া ডিপিপিতে ওই কাজের সংস্থান না থাকা সত্ত্বেও প্রাক্কলন প্রস্তুত, অনুমোদন ও বিল পরিশোধের মাধ্যমে পিপিআর-২০০৮-এর ১২৭ (২) (খ) (গ) বিধি অনুযায়ী ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশমূলক কার্যসম্পাদন দেখিয়ে সরকারের আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে।
এ ছাড়া লালমনিরহাটে হাজরানিয়া হাট থেকে চামটেরহাট রোড উন্নয়ন কাজের প্রাক্কলন কার্যাদেশ, চুক্তিপত্র, বিল-ভাউচার পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, রাস্তাটির চেইনেজ শূন্য মিটার থেকে ৪৪১০ মিটার পর্যন্ত মোট ৪৪১০ মিটার রাস্তাকে মাটির রাস্তা দেখিয়ে সংস্কার করা হয়েছে। কিন্তু ২০১৯ সালে প্রকাশিত রোড ইনভেন্টরি অনুযায়ী ওই সড়কের চেইনেজ ০ মিটার থেকে ১৯৫৬ মিটার পর্যন্ত মোট ১৯৫৬ মিটার বিটুমিনাস কার্পেটিং সড়ক বিদ্যমান। তাই বিটুমিনাস কার্পেটিং রাস্তাকে মাটির রাস্তা দেখিয়ে ঠিকাদারকে ১ কোটি ৬১ লাখ ৬৯ হাজার টাকা অতিরিক্ত বিল পরিশোধ করে সরকারের আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে এই টাকা মূলত ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন।
অন্যদিকে এলজিইডি পটুয়াখালী জেলায় ১১টি এবং টাঙ্গাইল জেলায় ৪টি মোট ১৫টি রাস্তার মোট ৬০,৪৪০ মিটার দৈর্ঘ্যরে মেরামত কাজ বাস্তবায়নের জন্য ঠিকাদারকে চুক্তি অনুযায়ী ৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়। কিন্তু স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর কর্তৃক প্রকাশিত রোড ডাটাবেজ অনুযায়ী উল্লিখিত ১৫টি সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ৫৪,৩৩০ মিটার। ফলে মোট দৈর্ঘ্য অপেক্ষা অতিরিক্ত ৬,১১০ মিটার দৈর্ঘ্যরে দেখিয়ে উন্নয়ন কাজের নামে প্রাক্কলন অনুমোদন ও চুক্তিপত্র করে অর্থ পরিশোধ করায় দুটি জেলায় সরকারের ৪ কোটি ৯ লাখ টাকা ক্ষতি করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এ বিষয়ে এলজিইডির সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় থেকে অডিট বিভাগকে লিখিতভাবে জানানো হয়-হালনাগাদ রোড ইনভেন্টরির সঙ্গে সম্পাদিত কাজের দৈর্ঘ্যরে মিল রয়েছে। তা ছাড়া প্রাক্কলন প্রস্তুতের সময় বাস্তবতা বিবেচনায় সড়কের দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করা হয়, যা ইনভেন্টরিতে বিদ্যমান দৈর্ঘ্যরে চেয়ে বেশি ছিল।
তবে অডিট বিভাগ বলছে এলজিইডির জবাব স্বীকৃতিমূলক হলেও আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য সহায়ক নয়। কারণ এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান সড়কের দৈর্ঘ্যরে চেয়ে অতিরিক্ত দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করে ঠিকাদারকে আর্থিক সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে সরকারকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। তাই অতিরিক্ত প্রদান করা অর্থ দায়ী ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা করা আবশ্যক।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এলজিইডির আওতাধীন প্রকল্প পরিচালক গুরুত্বপূর্ণ পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প (বরিশাল, ঝালকাঠি ও পিরোজপুর জেলা) (বিজেপি) এবং নির্বাহী প্রকৌশলী, পটুয়াখালী জেলা কার্যালয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে অস্তিত্ববিহীন সড়ক নির্মাণ দেখিয়ে সরকারের ৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা ক্ষতি করা হয়েছে। নিরীক্ষাকালে এলজিইডি, ঝালকাঠি কার্যালয়ের ২টি, পিরোজপুর কার্যালয়ের ১টি এবং পটুয়াখালী কার্যালয়ের ৬টি মোট ৯টি স্কিমের কাজের অনুমোদিত প্রাক্কলন, দরপত্র এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর কর্তৃক প্রকাশিত রোড ডাটাবেজ পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ৯টি স্ক্রিমের মধ্যে বিজেপি প্রকল্পের আওতায় পরিশিষ্টের ক্রমিক নং ১ ও ২-এর ক্ষেত্রে একই রোড আইডি নং-৫৪২৪৩৫৪০৯ এবং ক্রমিক নং ৩-এর রোড আইডি নং-৫৭৯১৪৪২২৩-এর বিপরীতে ৩টি প্যাকেজের মাধ্যমে সড়ক নির্মাণের নামে মোট ৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা প্রাক্কলন অনুমোদন করে ঠিকাদারকে কার্যাদেশ প্রদান এবং ২ কোটি ৫৬ লাখ ৮৪ হাজার টাকা পরিশোধ দেখানো হয়েছে।
একইভাবে নির্বাহী প্রকৌশলী, এলজিইডি, পটুয়াখালী কার্যালয় কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ৬টি স্কিমের কাজের নামে অনুমোদিত প্রাক্কলিত মূল্য ৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। ওই ৬টি স্কিমের বিপরীতে ঠিকাদারকে কার্যাদেশ প্রদান এবং ২ কোটি ৫৭ লাখ ৯৯ হাজার টাকা পরিশোধ দেখানো হয়েছে। কিছু প্রাক্কলন ও পরিশোধ-সংক্রান্ত রেকর্ডপত্রে যে রোড আইডি নং উল্লেখ করা হয়েছে ওই রোড আইডিগুলো স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর কর্তৃক প্রকাশিত জুন ২০২০-এর রোড ডাটাবেজে নেই। অর্থাৎ অস্তিত্বহীন সড়কের ৯টি প্যাকেজের মাধ্যমে সড়ক উন্নয়ন ও ব্রিজ নির্মাণ দেখিয়ে ঠিকাদারকে এই বিল পরিশোধ করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
এ বিষয়ে অডিট বিভাগের কাছে লিখিত জবাবে বিজেপি প্রকল্প জানায় যে, ডিপিপিতে স্কিমগুলো অন্তর্ভুক্ত আছে। পরবর্তী সময়ে পর্যালোচনা করে জবাব প্রদান করা হবে। এলজিইডির পটুয়াখালী কার্যালয় জানায় যে, হালনাগাদ রোড ইনভেন্টরি সংশোধন করা হচ্ছে সেখানে সব সড়ক অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে অডিটি প্রতিষ্ঠানের জবাব আপত্তি নিষ্পত্তির সহায়ক নয় মন্তব্য করে অডিট বিভাগ বলেছে স্কিমগুলো ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত আছে বলা হলেও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর কর্তৃক প্রকাশিত জুন ২০২০-এর রোড ডাটাবেজে ওই রোড আইডিতে কোনো সড়কের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া রোড ইনভেন্টরিতে কোনো সড়ক অন্তর্ভুক্ত না থাকলে সে সড়কের নামে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণে অস্তিত্ববিহীন সড়কের নামে প্রাক্কলন অনুমোদন ও ঠিকাদারকে অর্থ পরিশোধ দেখানোর জন্য দায়দায়িত্ব নির্ধারণপূর্বক আপত্তির অর্থ আদায়যোগ্য।
এ বিষয়ে জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব কমিটির সভাপতি মো. রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, সরকারি বিভিন্ন অধিদফতর ও সংস্থার প্রচুর আর্থিক অনিয়ম-সংক্রান্ত অডিট আপত্তি সংসদীয় কমিটি যাচাই-বাছাই করছে। দফায় দফায় বৈঠক করে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এলজিইডির অডিট আপত্তির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধেও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করা হবে।
সময়ের আলো/আরএস/