সিন্ডিকেট করে একটি পণ্যের দাম বাড়িয়ে লুটপাট চালানো, পরক্ষণেই আরেক পণ্যে সিন্ডিকেট। গত দেড় থেকে দুই বছর এভাবেই ভোক্তার পকেট খালি করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এখন সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে আলু নিয়ে ঘাটে ঘাটে বাণিজ্য করছে ব্যবসায়ীরা। মূলত হিমাগার মালিকরাই এ ক্ষেত্রে হোতার ভূমিকা পালন করছে। দাম বেঁধে দেওয়া হলেও সরকারি সংস্থাগুলো সময়মতো পদক্ষেপ নিতে না পারায় বাজারে আলুর দাম কমেনি। চড়া দরেই তা বিক্রি হচ্ছে।
৭-৮ টাকায় কৃষকের কাছ থেকে কেনা ও হিমাগারে সংরক্ষণ ব্যয়সহ যে আলু কেজিপ্রতি মূল্য পড়ে ১৪ থেকে ১৫ টাকা, সরকার সেই হিমাগারেই আলুর দাম বেঁধে দিয়েছে ২৬ টাকা। সেই দামও না মেনে হিমাগার থেকে আলু বিক্রি করা হচ্ছে ৩৫ থেকে ৩৬ টাকায়।
গতকাল সোমবার রাজধানীর কল্যাণপুর, নতুন বাজার, কারওয়ান বাজারসহ আরও কয়েকটি বাজার ঘুরে এবং হিমাগার মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হিমাগার থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা নিয়ে বিক্রি করছে ৪০ থেকে ৪২ টাকায়। খুচরা ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজি আলু বিক্রি করছে ৫০ টাকায়। অথচ সরকার খুচরাতে আলুর দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে ৩৫-৩৬ টাকা। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান সময়ের আলোকে বলেন, ‘ভোগ্যপণ্যের বাজারে মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারি সংস্থাগুলো সময়মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারছে না। যতক্ষণে উদ্যোগ নিচ্ছে ততক্ষণে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট করে দেশের মানুষের অর্থ লোপাট করা শেষ হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি অনেকটা ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’ এই প্রবাদের মতো অবস্থা। সরকার পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সময়মতো পদক্ষেপ নিতে না পারায় বা কার্যকর ব্যবস্থা নিতে না পারায় ভোগ্যপণ্যের বাজার এতটা টালমাটাল।’
সরকার বেঁধে দিলেও সে দামে আলু বিক্রি না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এএইচএম শফিকুজ্জামান সময়ের আলোকে বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যে মূল্য বেঁধে দিয়েছে সে দর কার্যকর করতে মহাপরিচালক হিসেবে আমি নিজেসহ আমার সব জেলা কর্মকর্তা আলুর বাজারে নেমেছেন। আমি মুন্সীগঞ্জ গিয়ে হিমাগারে অভিযান চালিয়েছি, মঙ্গলবার (আজ) যাব বগুড়ায়। সেখানে বেশ কিছু হিমাগার পরিদর্শন করব এবং সেখানকার আলু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করব। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি, আমরা বসে নেই। প্রতিদিনই বাজারে অভিযান চালাচ্ছি। আলুর বাজার অস্থির করা চক্রটিকে আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আশা করছি খুব দ্রুতই আলুর দাম কমে আসবে।’
গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আলুসহ ৫ পণ্যের দাম কমিয়ে নতুন মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। তাতে উল্লেখ করা হয়, ১ কেজি আলুতে কৃষকের মোট ব্যয় হয় ১২ টাকা ৩২ পয়সা। এর সঙ্গে যৌক্তিক লাভ ১৫ শতাংশ ধরলে আসে ১ টাকা ৮৫ পয়সা। সব মিলে উৎপাদক পর্যায়ে ১ কেজি আলুর যৌক্তিক মূল্য পড়ে ১৪ টাকা ১৭ পয়সা। কৃষি বিপণন অধিদফতরের তালিকা অনুযায়ী পাইকারি পর্যায়ে ক্রয় মূল্য পড়ে ১৪ টাকা ১৭ পয়সা। এর সঙ্গে যুক্ত হবে স্থানীয় পরিবহন ব্যয় কেজিতে ১ টাকা ৪৫ পয়সা, অন্যান্য বিপণন ব্যয় ৩ টাকা, হিমাগার ভাড়া ৫ টাকা, আড়ৎ কমিশন ১ টাকা ৫০ পয়সা। সব মিলে পাইকারি ব্যবসায়ীর কেজিতে মোট ব্যয় পড়ে ২৫ টাকা ১২ পয়সা। এর সঙ্গে ১০ শতাংশ যৌক্তিক লাভ ধরা হয়েছে ২ টাকা ৫১ পয়সা। সব মিলে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি আলুর যৌক্তিক মূল্য ধরা হয়েছে ২৭ টাকা ৬৩ পয়সা। এরপর খুচরা পর্যায়ে আলুর যে মূল্য তালিকা দেওয়া হয়েছে তাতে দেখা যায়, খুচরা ব্যবসায়ী, পাইকার বাজার থেকে প্রতি কেজি আলু কিনবে ২৭ টাকা ৬৩ পয়সায়। এর সঙ্গে যুক্ত হবে বিপণন ব্যয় ৩ টাকা ৫৬ পয়সা। এতে কেজিতে মোট মূল্য পড়ে ৩১ টাকা ১৯ পয়সা। ১৫ শতাংশ যৌক্তিক লাভ ধরলে হয় ৪ টাকা ৬৮ পয়সা। সব মিলে খুচরা পর্যায়ে ১ কেজি আলুর দাম পড়ে ৩৫ টাকা ৮৭ পয়সা। কৃষি বিপণন অধিদফতরের আলুর এই মূল্য তালিকা গত বৃহস্পতিবার ঘোষণা দেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।
তবে আলুর বাজারের বাস্তব চিত্র বলছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। এ ক্ষেত্রে প্রথম বিষয় হচ্ছে, উৎপাদক পর্যায়ে আলুর যে মূল্যের কথা বলা হয়েছে সেটি মূলত হিমাগারের মূল্য। অথচ উৎপাদক বলতে মূলত কৃষককেই বোঝায়। এই কৃষক কত টাকায় আলু বিক্রি করেছে কিংবা প্রতি কেজি আলু হিমাগারে কত টাকায় রেখেছে সে তথ্য দেওয়া হয়নি। কৃষক পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, একজন কৃষক আলু উত্তোলনের সময় হিমাগারে প্রতি কেজি আলু রাখে ৭ টাকা কেজি দরে। এর সঙ্গে হিমাগার ভাড়া দিতে হয় কেজিতে ৫ থেকে ৭ টাকা। মূলত হিমাগারে আলু যাওয়ার পরই সেটি কৃষকের হাতছাড়া হয়ে হিমাগার মালিকের কব্জায় চলে যায়। হিমাগার মালিক তখন ইচ্ছেমতো দামে বিক্রি করে আলু। এতে কৃষককে একটি টাকাও বাড়তি লাভ দেওয়া হয় না। মুন্সীগঞ্জের সদর উপজেলার কৃষক আবুল কালাম বলেন, ‘মার্চ মাসে যখন আমরা হিমাগারে আলু রাখতে যাই তখন প্রতি কেজি আলুর দাম পেয়েছি ৭ থেকে ৮ টাকা। অথচ সেই আলু এখন হিমাগারেই বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকার ওপরে। আসলে আমাদের কাছ থেকে আলু হিমাগারে যাওয়ার পর সেটি আর আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। আমরা যারা কৃষক তাদের অনেকেই আলু চাষের সময় হিমাগারের মালিকের কাছ থেকে ঋণ নিই। ফলে আলু তোলার পর হিমাগারের চাহিদামতো দামেই তাদের কাছে দিয়ে দিতে হয়। আমাদের কাছ থেকে পানির দামে কিনে তারা তিন-চারগুণ বেশি দরে বিক্রি করছে। আর ৭-৮ টাকার আলু ক্রেতাকে কিনতে হচ্ছে ৫০ টাকায়। আমি নিজেও ৭-৮ টাকায় আলু বিক্রি করে এখন ৫০ টাকায় কিনে খাচ্ছি।’
বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু নিজেই শিকার করলেন, আলু নিয়ে মূল সিন্ডিকেট করছেন গুটিকয়েক হিমাগার মালিক। তার দাবি, এর সঙ্গে সব হিমাগার মালিক জড়িত নন। তিনি বলেন, সরকার নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি হলেও সবাই মুনাফা করবেন, কিন্তু সেই ক্ষেত্রে মুনাফা কিছুটা কম হবে হয়তো। এটাও অনেক ব্যবসায়ী মানতে পারছে না। তারা বাড়তি মুনাফার জন্যই সরকারি দামে আলু বিক্রি না করে এখনও চড়া দামেই বিক্রি করছে। এর বাইরেও আলুর কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী তৈরি হয়েছে এখন, যারা হিমাগারের আলু কিনে নিচ্ছে। পরে তারা বেশি দামে বিক্রি করছে। বিষয়গুলো আমাদের নজরে এসেছে। আমরা এই সিন্ডিকেট ভাঙতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছি।’
দেশে এখনও আলুর মজুদ ১৫-১৬ লাখ টন
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে আলুর বার্ষিক চাহিদা ৭৫-৮০ লাখ টন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর আলু উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৬ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ কোটি ১ লাখ ৪৪ হাজার ৮৩৫ টন এবং ২০২০-২১ ৯৮ লাখ ৮৭ হাজার ২৪২ টন আলু উৎপাদন হয়। আর এখন হিমাগারগুলোতে প্রায় ১৫-১৬ লাখ টন আলু মজুদ রয়েছে। তাই দেশে আলুর কোনো সংকট নেই। পর্যাপ্ত আলু থাকার পরও শুধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে আলুর বাজার বেসামাল।
সময়ের আলো/আরএস/