একসময়ের ত্যাগী ও পোড় খাওয়া নেতারা এখন বিএনপির কাছে খড়কুটোর মতো মূল্যহীন। সিদ্ধান্ত অমান্য করে স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় তাদের কয়েকজন দল থেকে বহিষ্কার হন। যদিও তাদের ভাষ্য, স্থানীয় নেতাকর্মী ও জনগণের চাহিদার কারণে নির্বাচনে অংশ নেন তারা। ভুল স্বীকার করেও মাফ পাননি।
এমন বাস্তবতায় আজ আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার গড়া দল তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিচ্ছেন অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দাকার, যিনি ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক। এ ছাড়া বিএনপির এমন আরও কয়েকজন বহিষ্কৃত নেতা তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিতে পারেন। তাদের সাবেক দল বিএনপি বলছে, যে কেউ অন্য দলে যেতে পারে। এতে কোনো আফসোস নেই। বিএনপিতে খড়কুটোর মতো অনেকে আসবে ও যাবে। এখন পর্যন্ত তাদের দলে ফিরিয়ে নেওয়ার চিন্তা নেই।
তৃণমূল বিএনপি আজ তাদের প্রথম কাউন্সিলে চমক দেখাতে চায়। দলটির শীর্ষ পদে ভেড়াতে চায় বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী ও চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য (বহিষ্কৃত) তৈমূর আলম খন্দকারকে। শুধু তারা নয়, পর্যায়ক্রমে বিএনপি থেকে বিভিন্ন সময় বাদ পড়া এবং নিজ থেকে ছেড়ে দেওয়া নেতারাও এ দলে যোগ দেবেন বলে জানা গেছে। সেই তালিকায় বহিষ্কৃত বিএনপি নেতা ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের সংসদ সদস্য উকিল আবদুস সাত্তারও আছেন।
এসব বিষয়ে সোমবার বিএনপির সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন ছিল-দল কি তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেবে? জবাবে তাচ্ছিল্যসুরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘তৈমূর আলম খন্দকার ও শমসের মবিন চৌধুরী এখন আমাদের দলের সদস্য নন। তারা তাদের মতো সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন। এটা তাদের ব্যাপার। বিএনপি একটি প্রবহমান নদীর মতো। এখানে কত খড়কুটো আসে, কত খড়কুটো যায়। এতে আমাদের কিছু যায় আসে না’।
আর দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান বলেন, ‘বিএনপি বাকশালের দল নয় যে সারা দেশের মানুষকে বলবে, শুধুই একটি দল বিএনপিই করবে। আমাদের দল ছেড়ে চলে গেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উকিল আবদুস সাত্তার। তাতে কী হয়েছে-রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তন এসেছে? যার ইচ্ছে অন্য দল করবে’।
নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি যখন জোরালো আন্দোলনের দিকে যাচ্ছে তখন বহিষ্কৃত বেশ কয়েকজন পরিচিতি নেতা দলের কর্মকাণ্ড থেকে দূরে আছেন। তাদের অভিযোগ, দলের হাইকমান্ডকে ভুল বুঝিয়ে, কান ভারী করে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এখনও প্রত্যাশা নির্বাচনের আগে দল তাদের ফিরিয়ে নেবে।
বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম মঞ্জু। মাঠের রাজনীতিতে ত্যাগী ও জনপ্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিত তিনি। লড়াই করেছেন খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও। রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামে তার অবদান নিয়ে বিতর্ক নেই। খুলনা জেলা ও মহানগর কমিটি গঠন নিয়ে দলের সিদ্ধান্তে আপত্তি তোলায় প্রায় দুই বছর আগে মঞ্জুকে বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এখনও তাকে দল ফিরিয়ে নেয়নি।
কীভাবে কাটছে সময়-জানতে চাইলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নজরুল ইসলাম সময়ের আলোকে বলেন, ‘হা হা হা! এই তো যাচ্ছে সময়। এখনও মাথায় অনেক মামলা। এগুলোর হাজিরা দিচ্ছি। দলে পদ না থাকলেও কর্মীরা আমার সঙ্গে আছে। বিএনপি আমাদের ছাড়তে পারে। কিন্তু আমরা কখনো দল ছেড়ে যাব না। এই বিএনপিকে আমরা মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে গেছি। খারাপ লাগে, আমার জন্য খুলনার দুই শতাধিক নেতাকর্মী পদত্যাগ করে দলের রাজনীতি থেকে দূরে আছেন। আশা করি বিএনপি আমাদের ঠিকই ফিরিয়ে নেবে।’
নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন কেন্দ্র করে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে সরাসরি দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল জেলার আহ্বায়ক তৈমূর আলম খন্দকারকে। তিনি সময়ের আলোকে বলেন, ‘কিছু কেন্দ্রীয় নেতা ঢাকায় বসে নারায়ণগঞ্জের বিষয়ে খবরদারি করছে। দুঃসময়ে দল আমাকে ত্যাগ করেছে। আমি সুবিধাভোগী নই। ১৯৯৬ সালে বিএনপি বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় আমি এ দলে যোগদান করি। এ দল করতে গুলি খেয়েছি, একাধিকবার জেল খেটেছি। এমনকি ১/১১ তে যখন তারেক রহমানকে আটক করা হলো তার পক্ষে আইনি লড়াই করি।’ তৈমূরের সঙ্গে তার নির্বাচনের চিফ এজেন্ট নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামালকেও বহিষ্কার করা হয়।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন শমসের মবিন চৌধুরী। তিনি একসময় যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ২০০৮ সালে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন এবং ২০০৯ সালে দলের ভাইস চেয়ারম্যান হন। ২০১৫ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপির রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। পরে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বিকল্পধারা বাংলাদেশে যোগ দেন। তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দেওয়া নিয়ে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
টিভি টকশোতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ইঙ্গিত করে বক্তব্য দিয়ে বিরাগভাজন হন কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান রঞ্জন। এরপরই তাকে বহিষ্কার করা হয়।
তিনি সময়ের আলোকে বলেন, ‘ভালো আছি।দলের মধ্যেই আছি। নেতাকর্মীরা আমাকে ছাড়া কই যাবে। এলাকার মানুষের সঙ্গে আছি। সামর্থ্য অনুযায়ী, এলাকার নেতাকর্মীদের পাশে থাকার চেষ্টা করছি।’ কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রথমবারের মতো পরাজিত হন মনিরুল হক সাক্কু। নির্বাচন করায় বিএনপি থেকে আজীবন বহিষ্কার হয়ে এখন অনেকটাই একঘরে হয়ে পড়েছেন তিনি। জানতে চাইলে সাক্কু বলেন, ‘আমি মনে করি, বহিষ্কারও একটা পদ। কুমিল্লার মানুষের চাহিদার কারণেই আমি নির্বাচন করেছি। আমি গত ৪২ বছর ধরে বিএনপির রাজনীতি করি। আমি বিএনপি ছাড়ব না। দল ডাকলে সাড়া দিতে সবসময় প্রস্তুত আছি।’
বহিষ্কার করা না হলেও অনেকটা মনোকষ্টে দূরে আছেন সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহসানুল হক মিলন। এখন বিএনপিতে কোনো অবস্থান নেই মিলনের। বিএনপির সময় পরীক্ষায় নকল বন্ধ করে বেশ সুনাম কুড়িয়েছিলেন। তিনি ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। গত বছরের ৬ এপ্রিল এ পদ থেকে সরিয়ে করা হয় নির্বাহী সদস্য। এরপর থেকে তাকে দলের কর্মকাণ্ডে তেমন দেখা যায় না।
এদিকে বিএনপি নতুন নিবন্ধিত দল তৃণমূল বিএনপিকে ভালো চোখে দেখছে না। মনে করা হচ্ছে, আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও তৃণমূল বিএনপি অংশ নেবে। তখন বিএনপিতে যারা নির্বাচন করতে আগ্রহী থাকবেন তারা এ দলে যোগ দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেবেন। যেমনটা উপনির্বাচনে উকিল সাত্তার ভূইয়া করেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সম্প্রতি সময়ের আলোকে বলেন, ‘বহিষ্কৃতদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে এখনও আলোচনা হয়নি। আগে স্থায়ী কমিটিতে উত্থাপন হতে হবে। তারপর সিদ্ধান্ত হবে। তবে এটাও দেখতে হবে, তারা এখন দল করতে চান কি না। তাদের আগ্রহসহ কিছু বিষয় ভাবতে হবে।’
সময়ের আলো/আরএস/