প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ৮:৫৮ পিএম আপডেট: ১৯.০৯.২০২৩ ৯:০৪ পিএম | অনলাইন সংস্করণ Count : 585
১২ বছর আগে স্বামীকে হারিয়ে পরের দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করে সংসার চলে তোয়ারা বেগমের। সেই থেকে অল্প অল্প করে যে টাকা জমিয়েছিল; সেই টাকা দিয়ে একটি গরু কিনেছিল। কিন্তু হাতুড়ে পশু চিকিৎসকের খপ্পরে পড়ে সুস্থ গরুকে ভ্যাকসিন দিয়েছিল। সেই ভ্যাকসিনে তার তিল তিল করে জমানো সম্পদটি হারিয়ে সে এখন দিশেহারা।
রোববার (১৭ সেপ্টেম্বর) চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের যাদুপুর গ্রামের স্থানীয় একটি মসজিদে মাইকিং প্রচার করে গরু-ছাগলকে সরকারিভাবে ভ্যাকসিন দেওয়ার কথা বলে হাতুড়ে পশু চিকিৎসক। সেই হাতুড়ে চিকিৎসকের ফাঁদে পড়ে এলাকাবাসী। ভ্যাকসিন দেওয়ার রাত পার হতে না হতেই সোমবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকেই গরুর অসুস্থতা দেখা দেয়। আসতে আসতে এক এক করে মঙ্গলবার (১৯ সেপ্টেম্বর) দুপুর পর্যন্ত নয়টি গুরু মারা গেছে। অসুস্থ হয়েছে শতাধিক গরু।
শুধু তোয়ারা বেগমের নয়। এই ঘটনায় শরিফুল ইসলামের ১টি ও শহিদুল ইসলামের ১টি, মাহবুব আলীর ২টি , শরিফুল মুনসীর ১টি, আব্দুল আওয়ালের ১টি, ভুলু মন্ডলের ১টি ও ইব্রাহীম আলীর ১টি, সন্ধ্যার পরে আরও একটি গরুসহ মোট ১০টি গরু মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
সরেজমিনে গিয়ে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সদর উপজেলা প্রাণীসম্পদ অফিসের উপসহকারী প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা নাইমুল হক এর ভাতিজা মাইনুল ইসলাম নিজেকে সরকারি পশু চিকিৎসক হিসেবে এলাকায় পরিচয় দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছিল। তাকে সঙ্গে নিয়ে এর আগেও একাধিকবার ভ্যাকসিন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছিল। সেই থেকে স্থানীয়রা তাকে সরল মনে বিশ্বাস করে ভ্যাকসিন দেওয়ার অনুমতি দেয়। বিভিন্নজনকে আবার নানা অজুহাত দেখিয়ে ভ্যাকসিন দিতে চাপ প্রয়োগ করে। আর ভ্যাকসিন না দিলে পরে তিন হাজার টাকা দিয়ে সরকারিভাবে ভ্যাকসিন দিতে হবে মর্মে একাধিক ব্যক্তিকে জানান।
বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের যাাদুপুর জোলাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ইব্রাহীম আলী ঋণ করে গরু কিনেছিল। সেই গরুটি হাতুড়ে ডাক্তারের ভ্যাকসিনের কারণে সোমবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় মারা গেছে। ঋণের টাকা কেমন করে পরিশোধ করবে এই নিয়ে সে হায়-হুতাশ করছে।
সদর উপজেলা প্রাণীসম্পদ (ভারপ্রাপ্ত) কর্মকর্তা ডা. মো. আখতারুজ্জামান জানান, আমরা ভ্যাকসিনের কারণে গরু মারা যাওয়ার খবরটি পেয়ে রাতেই স্থানীয় প্রশাসনসহ ঘটনাস্থল ভিজিট করেছি। আজ সকালে গরুগুলো কি কারণে মারা গেছে। সেটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য জয়পুরহাট থেকে বিশেষজ্ঞ দল ময়নাতদন্ত ও নমুনা সংগ্রহের জন্য একটি টিম এসেছেন। সেই টিম নমুনা সংগ্রহ করেছে। সেগুলো ল্যাবে পরীক্ষা করলে; কি কারণে গরুগুলো মারা গেছে তা জানা সম্ভব হবে।
ঘটনার বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত উপসহকারী প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা নাইমুল হকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। অপর অভিযুক্ত হাতুড়ে পশু চিকিৎসক মাইনুল ইসলামের ফোন নম্বরে কল হলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাছমিনা খাতুন জানান, স্থানীয় সূত্রে গরু মারা যাওয়ার বিষয়টি আমরা জানতে পেরে রাতেই জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নির্দেশে স্থানীয় সরকার বিভাগরে উপপরিচালক স্যারের নেতৃত্বে আমি, এ্যাসিল্যান্ড,ডিএলও রাতেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। আমরা জানতে পেরেছি সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের উপসহকারী প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা নাইমুল ইসলামের ভাতিজা মাইনুল ইসলাম অবৈধভাবে ভ্যাকসিনগুলো নিয়ে প্রয়োগ করেছিল। সেই কর্মকর্তার দায়িত্বের অবহেলার কারণে তার ভাতিজার বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আর ডিএলওকে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা নাইমুল ইসলামকে শোকজ করার জন্য বলা হয়েছে। আরও সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, মারা যাওয়া গরুগুলোর শ্যাম্পল সংগ্রহ করে; সেগুলোা ল্যাবে টেস্ট করার জন্য। যদি ভ্যাকসিনে কোন ত্রুটি থাকে; তাহলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে। আর যদি ভ্যাকসিন দেওয়ার কারণে গরু মারা গিয়ে থাকে। তাহলে সেই ব্যক্তির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থ গরুর মালিকদের দেয়া হবে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান গরু মারা যাওয়ার ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রনালয়ের সচিব আশার কারণে তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারিনি। আমি রাজশাহী বিমানবন্দর গিয়েছিলাম। সেখান থেকে এসে তদন্ত কমিটি গঠন করবো। আর তদন্তে প্রমাণিত হলে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তিনি আরও জানান, সদর উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা উপসহকারী প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা নাইমুল হককে শোকজ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। এছাড়া এই ঘটনাটি প্রাণীসম্পদ বিভাগের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।
সময়ের আলো/জিকে