ই-পেপার বৃহস্পতিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৩
বৃহস্পতিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৩

রাসুল (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা
মওলবি আশরাফ
প্রকাশ: শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ২:২০ এএম  (ভিজিট : ২০০)
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না তার কাছে মাতাপিতা, সন্তানাদি ও সবার চেয়ে আমি বেশি প্রিয় না হব’ (বুখারি : ১৫)। মহানবী (সা.) এর এই হাদিস থেকে বুঝে আসে-ঈমানের পূর্ণতার জন্য বুনিয়াদি শর্ত হলো আল্লাহর রাসুলকে মহব্বত করা। নামেমাত্র মহব্বত নয়, একজন মানুষের সবচেয়ে আপন হয় তার পিতামাতা, তারপর সন্তানাদি, তারপর অন্য কোনো মানুষ-তাদের সবার চেয়ে আল্লাহর রাসুলের প্রতি বেশি মহব্বত হতে হবে এবং সেটা আবার মুমিন হওয়ার পূর্বশর্ত। 

পবিত্র কুরআনেও একই নির্দেশনা আছে-মুমিনের জন্য ভালোবাসার মূল কেন্দ্র স্বয়ং আল্লাহ, তারপর হজরত মুহাম্মদ (সা.)। আর বাকি দুনিয়ার যত প্রেমময় মানুষ আছে, যত রকমের ভালো লাগার জিনিস আছে-সবকিছুর অবস্থান দ্বিতীয়তে। এ থেকে বোঝা যায়, আল্লাহর রাসুলকে ভালোবাসা আমাদের প্রত্যেকের জন্য আবশ্যক। কেননা দুনিয়াতে ভালোবাসার যত কিছু আছে তার সবই তাঁর কারণে প্রেমময়। যদি তিনি আল্লাহর জন্য পরস্পরকে ভালোবাসতে না বলতেন, আত্মীয়তা ছিন্ন করতে না বলতেন, সামাজিকভাবে এক থাকতে না বলতেন, আশরাফ-আতরাফ, ধনী-গরিব, সাদা-কালো ভুলে গিয়ে এক কাতারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামাজ পড়তে না বলতেন-আমাদের মধ্যে এসব করার আগ্রহই তৈরি হতো না। আমরা তখন হতাম বিচ্ছিন্ন, শক্তিহীন, আমাদের কোনো সুখ থাকত না। মানুষ সামাজিক প্রাণী বটে, নিজ প্রয়োজনে দলবদ্ধ হয়ে থাকে। কিন্তু আটলান্টিকের এই পাড় থেকে চীনের সীমান্ত পর্যন্ত ভাই ভাইয়ের সম্পর্ক ও স্বর্ণময় এক সভ্যতা গড়ে তোলা তার চেয়ে অনেক বড় বিষয়। আর তা একমাত্র সম্ভব হয়েছে রাসুলের প্রতি আমাদের ভালোবাসা থাকার কারণে। এই শিক্ষা তিনি আমাদের দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে কখনো তার ওপর জুলুম করে না এবং জালিমের হাতে তাকে ছেড়ে দেয় না।’ তারপর বলেছেন, ‘এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য প্রাচীরের মতো, যার একাংশ অপরাংশকে শক্তি জোগায়।’ (বুখারি : ৫/৯৭-৯৯) 

ভালোবাসা দুই ধরনের হয়- ১. স্বভাবজাত। ২. মস্তিষ্কজাত। পিতামাতা, স্বামী বা স্ত্রী, সন্তানাদির প্রতি ভালোবাসা স্বভাবজাত। আপনি জন্মলাভ করে যাদেরকে দেখেছেন আপনাকে জানপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে, বিপরীতে তার প্রতিও ভালোবাসা তৈরি হয়ে যাবে। তারপর, নারী ও পুরুষের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ স্বভাবজাত, আল্লাহ তায়ালাই বংশবৃদ্ধি ও মানবজীবনকে উদ্দেশ্যময় বানাতে এই নিয়ম তৈরি করেছেন। সন্তানাদির প্রতি ভালোবাসাও একই রকম, মানুষ তাদেরকে নিজেরই অংশ মনে করে, সন্তানের মুখে নিজেরই ছায়া দেখে, এই কারণে তাদের ভালোবাসে। এসব ভালোবাসায় মস্তিষ্কের ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু যদি মস্তিষ্কের ব্যবহার করে কাউকে ভালোবাসা হয়, সেই ভালোবাসা স্বভাবজাত ভালোবাসা থেকে একদম আলাদা আর কঠিন হয়। সেখানে থাকে আদর্শ ও বিশ^াস। সেই ভালোবাসা মানুষের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সেই ভালোবাসার জন্য মানুষ পিতামাতা ও স্ত্রী-সন্তানদেরও বিসর্জন দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। কেননা সেখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায় বিশ^াস; আর বিশ^াসই মানুষের চালিকাশক্তি, প্রসেসর-একে ছাড়া চলা সম্ভব নয়।

আল্লাহর রাসুলের (সা.) প্রতি আমাদের মহব্বত ও ভালোবাসা মস্তিষ্কজাত। তাই তো সাহাবায়ে কেরাম তাঁর প্রতি ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে এভাবে জান উৎসর্গ করেছিলেন, তাঁকে ছাড়া দুনিয়ার কোনো কিছুর পরোয়া করেননি। এই ভালোবাসার শক্তিতেই হজরত আবু বকর (রা) ঘরের যাবতীয় সহায়-সম্বল আল্লাহর রসুলের কদম মোবারকের সামনে রেখেছিলেন। ‘ঘরে কী রেখে এসেছো’ জিজ্ঞেস করা হলে বলেছিলেন- ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে’।

হজরত হানজালা (রা.) যেই আল্লাহ রাসুলের আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার খবর শুনেছেন, বাসর ঘরে নববধূকে ফেলে রেখে ছুটে গেছিলেন রণাঙ্গনে, পেছনে ফিরেও তাকাননি। প্রায় প্রত্যেক সাহাবির জীবন ও কর্মে এমন ভালোবাসার উদহারণ আমরা পাই। কেউ পিতামাতাকে ত্যাগ করেছিলেন, কেউ ধনাঢ্য জীবন, আবার কেউ স্ত্রীকে, কেউ বা প্রিয়তমাকে। কারণ একটাই রাসুলের প্রতি তাদের মস্তিষ্কজাত ভালোবাসা, যা সব ভালোবাসার ঊর্ধ্বে। 

কিন্তু মস্তিষ্কজাত ভালোবাসা প্রগাঢ় হতে পারে কেবল মস্তিষ্কের ব্যবহারেই। আর মস্তিষ্ক তখনই কেবল সচল হবে যখন বেশি বেশি আল্লাহর রাসুলের (সা.) জীবনাদর্শ সম্পর্কে জানবে, তাঁর সিরাত পাঠ করবে। কারণ পরিচয়-পরিচিতি অর্জন ব্যতিরেকে কারও প্রতি মাস্তিষ্কজাত ভালোবাসা তৈরি হতে পারে না। বর্তমান সময়ে আমাদের বিভিন্ন সংকটের কারণও আল্লাহর রাসুলের (সা.) জীবন সম্পর্কে ধারণা না থাকা। তিনি ঠিক কীভাবে সংসার ও সমাজে চলার আদর্শ পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন, ব্যক্তিজীবনে আল্লাহর বাণীর প্রয়োগ কীভাবে ঘটিয়েছিলেন তা যদি আমরা না-ই জানি তা হলে কেমনে আমরা তাঁর অনুসরণ করব? শুধু পোশাক-আশাকের অনুসরণ ভালোবাসার প্রকাশ নয়, প্রকৃত ভালোবাসা আল্লাহর রাসুলের কর্মপন্থা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই সম্ভব। কিন্তু সেই অবস্থান থেকে আমরা দিনকে দিন আরও দূরে সরে যাচ্ছি, আমাদের মুখেই শুধু ভালোবাসার প্রকাশ, অন্তর একদম ফাঁকা। 

অনেক জায়গায় দেখা যায়, রাসুলের প্রতি ভালোবাসা আমাদের পরস্পরকে এক করার বদলে খণ্ড খণ্ড দলে ভাগ করছে, ভাইয়ের ওপর ভাই জুলুম করছে। এই ঝগড়া-ফ্যাসাদের কারণ একটাই-যাঁকে আমরা ভালোবাসার দাবি করি তাঁর জীবন ও আদর্শ সম্পর্কে আমাদের প্রকৃত জ্ঞান না থাকা। যদি তাঁকে জানতাম, তা হলে তাঁর নিষেধ করা কাজ কিছুতেই সমর্থন করতাম না।

তো আমরা যদি প্রকৃত পক্ষেই ঈমানদার হতে চাই, ইহকাল ও পরকালে কামিয়াব হতে চাই, তা হলে আমাদের উচিত আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে জানা এবং সব ভালোবাসার ঊর্ধ্বে তাঁর ভালোবাসা প্রাধান্য দেওয়া। আল্লাহ আমাদের আমল করার তওফিক দান করুন।


সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড
এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫। ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com