পৃথিবীর জীবনে চলার পথে হঠাৎ আপনার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা। হাসিমুখে সালাম দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। কিছুক্ষণ আলাপ করে জানতে পারলেন, বন্ধুটি বিপদে পড়েছে। আপনি ছোট্ট একটি সুপরামর্শ দিয়ে বন্ধুর উপকার করলেন। খুবই সামান্য একটি উপকার; কিন্তু পরকালে চূড়ান্ত হিসাব-নিকাশের দিন দেখবেন-সেই হাসিমুখ, সেই সালাম আর সেই সুপরামর্শের ফলে আপনার সওয়াব ও প্রাপ্তির পাল্লা এত ভারী হবে যে, আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।
চোখ বন্ধ করে কল্পনা করুন, ষোলো বছরের একটা ছেলেকে আগুনের সামনে দাঁড় করানো হয়েছে। আগুনের প্রশস্ততা ও গভীরতা এতটাই প্রচণ্ড যে, নিরাপদ দূরত্ব থেকে বিশাল বড় এক গুলতির মাধ্যমে ছেলেটিকে আগুনে নিক্ষেপ করা হলো। কী ভয়াবহ দৃশ্য! কিন্তু ঘটনাটা সত্যি। এই ছেলেটি ছিলেন হজরত ইবরাহিম (আ.)। তিনি যেই সমাজে বসবাস করতেন, তাঁর পিতামাতাসহ সেখানকার সব মানুষ তাঁকে জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিল, কারণ তিনি সেই সমাজের জীবন-পদ্ধতি এবং আল্লাহ সম্পর্কে তাদের মতামতকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তাঁকে আগুনে নিক্ষেপ করার আগে, তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘হাসবিয়াল্লাহু ওয়া নিমাল ওয়াকিল’, ‘অর্থাৎ আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট এবং তিনি উত্তম অভিভাবক।’ তখন আল্লাহ সরাসরি আগুনকেই হুকুম করলেন, ‘হে আগুন! তুমি ইবরাহিমের জন্য শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ৬৯)
প্রখ্যাত তাফসির বিশারদ ইবনে কাসিরের তাফসির থেকে জানা যায়, এই হুকুমের সঙ্গে সঙ্গেই সমগ্র পৃথিবীর আগুন ঠান্ডা হয়ে যায়। হজরত কাব আহবার (রা.) বলেন, ওই দিন সারা দুনিয়ায় কেউই আগুন দ্বারা কোনো উপকার লাভ করতে পারেনি। শুধু তাই না, এর পরের আয়াতে অর্থাৎ সুরা আম্বিয়ার ৭০ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আর তারা তাঁর ক্ষতি সাধনের ইচ্ছা করেছিল। কিন্তু আমি তাদের দিলাম সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত।’ অর্থাৎ আল্লাহর ওপর ভরসাকারীর ক্ষতি কেউ করতে পারবে না, কেউ ক্ষতি করতে চাইলে উল্টো নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে। একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবিদের কাছে খবর আসে যে, আরবের মুশরিকরা তাদের সব সৈন্য নিয়ে মুসলিমদের আক্রমণ করতে আসছে। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) পাঠ করেন, ‘হাসবুনাল্লাহু ওয়া নিমাল ওয়াকিল’ অর্থাৎ ‘আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম সাহায্যকারী।’
আজকের পর্বে আমরা জানব, আল্লাহ হচ্ছেন ‘আল-হাসীব’। অর্থাৎ তিনি হিসাব গ্রহণকারী। তিনি তাঁর হিকমত ও ইলম অনুযায়ী বান্দার যাবতীয় ভালো-মন্দ কাজের হিসাব নেবেন এবং সেই অনুযায়ী প্রতিদান দেবেন। তাঁর চেয়ে নিপুণ ও পরিপূর্ণ হিসাবগ্রহীতা ও হিসাবরক্ষক আর কেউ নেই। তিনি জগতের সবকিছুর হিসাব রাখেন, এমনকি ক্ষুদ্রতম কাজের প্রতিফলও দিয়ে দেন। মানুষের প্রতিটি কাজের ও কথার, এমনকি চিন্তার হিসাবও লেখা আছে ‘আল-হাসীবে’র কাছে। সুরা আম্বিয়ার ৪৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আমি কেয়ামতের দিন ন্যায়বিচারের মানদণ্ড স্থাপন করব। সুতরাং কারও প্রতি জুলুম হবে না। যদি কোনো আমল সরিষার দানা পরিমাণও হয়, আমি তা উপস্থিত করব এবং হিসাব গ্রহণের জন্য আমিই যথেষ্ট।’ সুরা বাকারার ২৮৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর। বস্তুত তোমাদের মনে যা আছে তা প্রকাশ করো অথবা গোপন রাখো, আল্লাহ তাঁর হিসাব তোমাদের নিকট থেকে গ্রহণ করবেন।’
আল-হাসীব তাঁর সব বান্দার প্রতি খেয়াল রাখেন, অনুগ্রহ করেন, সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেন এবং ক্ষতি থেকে রক্ষা করেন। যারা আল-হাসীবের ওপর আস্থা রাখে, তিনি বিশেষভাবে সেসব বান্দার সমর্থন দিয়ে বিজয় লাভ করিয়ে দেন। তিনি তাওয়াক্কুলকারীদের জন্য যথেষ্ট। কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে, আল্লাহ তাঁর জন্য যথেষ্ট’ (সুরা তালাক, আয়াত : ৩)। অর্থাৎ তিনি তাদের দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় কাজের জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। আল-হাসীব আমাদের বলেন যে, তিনি সবকিছুর হিসাব করেন, এমনকি একদম সূক্ষ্ম কাজের হিসাবও তিনি নিয়ে থাকেন। মাঝেমধ্যে আমরা ছোট ছোট ভালো বা খারাপ কাজগুলোকে উপেক্ষা করি। অথচ ইসলামে ছোট এবং বড় উভয় কাজই গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ বলেছেন, ‘সুতরাং যে অণু পরিমাণ ভালো কাজ করবে সে তা দেখতে পাবে, আর যে অণু পরিমাণ মন্দ করবে সে তা দেখতে পাবে’ (সুরা যিলযাল, আয়াত : ৭-৮)। আবার সুরা কাহফ এর ৪৯ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে, যখন আমলনামা হাতে দেওয়া হবে, তখন বান্দা বলবেÑ‘এ কেমন গ্রন্থ! এ তো ছোট-বড় কিছুই বাদ দেয়নি; বরং এ সব হিসাব রেখেছে!’ এভাবে প্রতিটি কথা-কর্ম-চিন্তা সবকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব উপস্থাপন করা হবে। সেগুলো অস্বীকার করারও উপায় থাকবে না।
মহান আল্লাহর এই নামটিকে নিজের জীবনে কীভাবে প্রয়োগ করবেন? প্রথমত আত্মসমালোচনা করুন। সুরা ইসরার ১৪ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে, ‘পাঠ করো তোমার কিতাব, আজ তুমি নিজেই তোমার হিসাব-নিকাশের জন্য যথেষ্ট।’ প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে তাই নিজের হিসাব নিজে নিন। কারণ আল্লাহ হচ্ছেন ‘সারিউল হিসাব’ অর্থাৎ তিনি দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী। বর্ণিত হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক আগামীকালের জন্য সে কী অগ্রিম পাঠিয়েছে’ (সুরা হাশর, আয়াত : ১৮)। এই আগামীকাল হলো আখিরাত। তাই বুদ্ধিমান হলো সে, যে আগামীকালের জন্য চিন্তা করে, ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ভালো অথবা মন্দ, কোনো ছোট কাজকে ছোট হিসাবে দেখবেন না বা অবহেলা করবেন না। বিন্দু বিন্দুতেই সিন্ধু হয়। কোনো গুনাহর কাজ হয়ে গেলে আল-হাসীবের কাছে ছয় ঘণ্টার মধ্যে গুনাহ মাফ চেয়ে নিন। কারণ হাদিসে আছে, আপনার বাম কাঁধের ফেরেশতা গুনাহর কথা না লিখে ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। আপনি তওবা করে ফেললে সেটা লিখে রাখা হবে না। (সহিহুল জামে : ২০৯৭)
লেনদেনের ক্ষেত্রে সৎ থাকুন। আপনি যে আপনার লেনদেনে সৎ ছিলেন না, সেটা কেউ বুঝতে না পারলেও আল-হাসীব সেটা জেনে যাবেন এবং সেটা রেকর্ড থাকবে। কাজেই আপনি যেকোনো লেনদেনে-সেটা কর্মক্ষেত্রে হোক অথবা স্কুলে বা পরিবারে; এমনকি আপনার বাচ্চাদের মাঝে ভালোবাসা বা জিনিসপত্র ভাগ করার ক্ষেত্রেও সর্বদা সৎ থাকুন। সব ক্ষেত্রে আল-হাসীবের ওপর ভরসা রাখুন। আপনি যদি আল-হাসীবের ওপর আপনার পূর্ণ আস্থা রাখেন, শুধু তাঁর সন্তুষ্টির জন্য সব বিষয় তাঁর ওপর ছেড়ে দিয়ে, তাঁর আদেশ মেনে নিয়ে এবং তাঁর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করেন, তা হলে আপনি জীবনের যেকোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে সফল হতে পারবেন। সকাল-সন্ধ্যার আমলে সুরা তওবার ১২৯ নম্বর আয়াতটি সাতবার পড়ার চেষ্টা করুন-‘হাসবি আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুয়া আলাইহি তাওয়াক্কালতু ওয়া হুয়া রাব্বুল আরশিল আজিম’, অর্থাৎ, ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই। আমি তাঁরই ওপর নির্ভর করি। তিনি মহা আরশের অধিপতি।’ মানুষ যদি আল্লাহর ‘আল-হাসীব’ নামটি মনে রাখে, তা হলে সে তাঁর কাজকর্মের ব্যাপারে সতর্ক হবে।
সময়ের আলো/আরএস/