ই-পেপার বৃহস্পতিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৩
বৃহস্পতিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৩

সুবিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় ইসলাম
মাওলানা শামসুদ্দীন সাদী
প্রকাশ: শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ২:০৭ এএম  (ভিজিট : ৫৮৪)
সুন্দর ও সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনের প্রথম শর্ত সুবিচার ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। ন্যায়বিচার ব্যতীত সভ্য সমাজ নির্মাণ হতে পারে না। যে সমাজে ন্যায়নীতির বালাই নেই, সেটি পশুর সমাজে পরিণত হয়। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা ও জানমালের নিরাপত্তা বিধানের জন্য সুবিচার অত্যন্ত জরুরি। যেখানে সুবিচার ও ন্যায়পরায়ণতা থাকে না, সেই সমাজে অন্যায়-অবিচার, জুলুম-শোষণ ও দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে। 

সামাজিক সুবিচারের ক্ষেত্রে বৈষম্য করা যাবে না। আপনজন হলে বিচারে শিথিলতা করা, শত্রু হলে তার ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া-এভাবে সুবিচার প্রতিষ্ঠা হয় না। সমাজে তখনই সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলা যাবে যখন ঘোর শত্রুও ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ব্যাপারে নির্ভাবনায় থাকে। আল্লাহ তায়ালা ন্যায়বিচার সম্পর্কে বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাক। আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান কর। তা তোমাদের নিজের বা পিতামাতার অথবা ঘনিষ্ঠজনদের বিরুদ্ধে হলেও।’ (সুরা নিসা : ১৩৫)

মহানবী (সা.)-এর সুবিচার
আল্লাহর এই বিধান বাস্তবায়নে মহানবী (সা.) সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠায় এক বিরল আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। আইন ও বিচারের ক্ষেত্রে মহানবী (সা.) কখনো আপন-পর ব্যবধান করতেন না। কে বন্ধু কে শত্রু তা দেখতেন না। সেই ন্যায়বিচারের সুশীতল ছায়ায় বর্বর আরব জাতি এমন সুসভ্য জাতিতে পরিণত হয়েছিল, যাদের সামনে পৃথিবী অবলীলায় পদানত হয়েছে। 

দ্বিতীয় হিজরিতে বদরযুদ্ধে মুসলমানদের হাতে মক্কার ৭০ জন কাফের বন্দি হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন নবীজির আপন চাচা হজরত আব্বাস ও জামাতা হজরত আবুল আস ইবনে রবী। তারা তখনও মুসলমান হননি। বন্দিদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছিল- প্রত্যেককে মুক্তিপণ পরিশোধ করতে হবে। মুক্তিপণ ছাড়া কাউকে মুক্তি দেওয়া হবে না। নবীজি (সা.) এই সিদ্ধান্ত মান্য করে নিজের চাচা ও জামাতা থেকেও মুক্তিপণ আদায় করেন। একবার মাখযুম গোত্রের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের জনৈক মহিলা চুরি করল। উসামাহ (রা.) তাঁর ওপর আল্লাহর বিধান কার্যকর না করার সুপারিশ করলে রাসুল (সা.) তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, তুমি কি আল্লাহর নির্ধারিত শাস্তি মওকুফের সুপারিশ করছ? এরপর তিনি দাঁড়ালেন এবং লোকদের উদ্দেশে বললেন, ‘হে মানুষেরা! তোমাদের পূর্ববর্তীরা এজন্য ধ্বংস হয়ে গেছে যে, যখন তাদের মধ্যে মর্যাদাশীল কেউ চুরি করত তখন তারা তাকে ছেড়ে দিত। আর যখন দুর্বল কেউ চুরি করত তার ওপর শাস্তি প্রয়োগ করত। আল্লাহর শপথ! যদি মুহাম্মদের মেয়ে ফাতিমাও চুরি করত আমি অবশ্যই তার হাত কেটে দিতাম।’ (মুসলিম : হাদিস ১৬৮৮)

উমর (রা.)-এর সুবিচার
নবীজি ন্যায়পরায়ণ এমন এক কাফেলাও তৈরি করেছিলেন, যারা নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে সন্তানকেও ছাড় দেননি। সামাজিক সুবিচারের আদর্শ দৃষ্টান্ত মেলে দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর ঘটনায়। একবার এক বেদুইন থেকে খলিফা একটি ঘোড়া কিনলেন। ঘোড়ায় চড়ে কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ হোঁচট খেয়ে ঘোড়াটি খোঁড়া হয়ে গেল। হজরত উমর (রা.) মনে করলেন, ঘোড়ার পায়ে আগের থেকেই কিছু সমস্যা ছিল। তাই বেদুইনের কাছে ফেরত গিয়ে বললেন, তোমার ঘোড়া ফেরত নাও, এর পা ভাঙা। বেদুইন বলল, আমি যখন বিক্রি করেছি, তখন তার পা ভালো ছিল। আমি এখন ভাঙা পা-ওয়ালা ঘোড়া ফেরত নেব না। তারা উভয়ে হজরত কাজি শুরাইহ (রহ.)-কে সালিশ মানলেন। কাজি শুরাইহ (রহ.) দ্বিতীয় খলিফাকে বললেন, আপনি কি ঘোড়াটি সুস্থ অবস্থায় কিনেছিলেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। কাজি শুরাইহ বললেন, তাহলে আপনি ঘোড়াটি পূর্ণ মূল্য দিয়ে কিনে নিন। না হয় যে অবস্থায় নিয়েছিলেন সে অবস্থায় ফেরত দিন। 

কাজি শুরাইহ-এর এমন চমৎকার বিচারে খলিফা অভিভূত হলেন। বললেন, তুমি কালই কুফা চলে যাও। আজ থেকে তুমি কুফার বিচারপতি। 
একবার হজরত উমরের কাছে অভিযোগ এলো যে, তার ছেলে শাহমা মদ পান করেছে। হজরত উমর বিষয়টি বিচারকের কাছে না পাঠিয়ে নিজেই এর তদন্ত করলেন। তদন্তে প্রমাণিত হলো, শাহমা মদ পান করেছে। মদপানের শাস্তি ৮০ দোররা। হজরত উমর বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে নিজ হাতেই ছেলের পিঠে জনসম্মুখে দোররা মারা শুরু করলেন। কোনো শৈথিল্য দেখালেন না। আবু শাহমা বেত্রাঘাত সইতে না পেরে ৮০ দোররা খাওয়ার আগেই মারা গেলেন। বর্ণিত আছে, ছেলের মৃত্যুর পরে হজরত উমর (রা.) আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করেন।

আলী (রা.)-এর সুবিচার
তখন হজরত আলী (রা.) খলিফা। তাঁর ব্যবহৃত অতিপ্রিয় লৌহবর্মটি এক যুদ্ধে যাওয়ার পথে হারিয়ে গেল। একদিন দেখলেন, কুফার বাজারে এক ইহুদি সেই বর্মটি বিক্রি করছে। দেখেই হজরত আলী (রা.) চিনে ফেললেন এটি তাঁরই বর্ম। খলিফা ইহুদিকে বললেন, এটি আমার বর্ম। অমুক জায়গায় এটি ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গিয়েছিল। ইহুদি অস্বীকার করল। সে বর্মটি নিজের বলে দাবি করল। তারা উভয়ে বিচারক কাজি শুরাইহ (রহ.)-এর কাছে গেলেন। কাজি হজরত শুরাইহ (রহ.) খলিফাকে বললেন, আপনি দাবির পক্ষে দুজন সাক্ষী আনুন। খলিফা বললেন, আমার খাদেম ও আমার ছেলে হাসান হোসাইন সাক্ষী। বিচারক বললেন, আপনার ছেলের সাক্ষী আপনার জন্য গ্রহণযোগ্য হবে না। 

হজরত আলী (রা.) সমস্ত মুসলিম জাহানের খলিফা। বিচারকও তাঁর অধীন। কিন্তু সাক্ষী উপস্থিত করতে না পারায় তিনি ইহুদিকে বললেন, ঠিক আছে। বর্মটি তুমি নিয়ে যাও। আমার কাছে আর কোনো সাক্ষী নেই। ইসলামের এমন সৌন্দর্য ও ন্যায়বিচার দেখে ইহুদি তৎক্ষণাৎ মুসলমান হয়ে গেল। 

এই ছিল মহানবী (সা.)-এর হাতে গড়া সাহাবিদের সামাজিক সুবিচারের নমুনা। যেখানে শাসক একজন বেদুইনের কাছে বিচারে হেরে যান। খলিফা হেরে যান একজন ইহুদির কাছে। এমন সুবিচার ও ন্যায়নীতির কারণে পৃথিবীর মানচিত্রে আজ ইসলামের জয়জয়কার।


সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড
এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫। ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com