ক্লাস শেষে স্কুলের বাইরে বটগাছ তলায় বসে আছে টুটুল। সে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। ক্লাসে পড়া না পারায় টিচার তাকে শাস্তি দিয়েছে। তাই তার মনটা বেশ খারাপ। তা ছাড়া আজ অনেক দেরি হয়ে গেল, দাদু এখনও তাকে নিতে আসেনি। সে ভাবছে এখানেই বসে থাকবে, আজ বাসায় ফিরবে না। অনেক কিছু ভেবেচিন্তে তার চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ বটগাছ থেকে একটি আওয়াজ শুনতে পেল। কেউ যেন কাঁদছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল আশপাশে কেউ তো নেই। আবারও তাকাল। কিন্তু না কেউ নেই। তা হলে কাঁদছে কে? নাকি সে ভুল শুনছে? এবার সে ভালো করে শোনার চেষ্টা করল। হ্যাঁ, কান্নার আওয়াজই তো! কেউ কাঁদছে। টুটুল জিজ্ঞেস করল, কে? জবাব এলো-আমি বটগাছ তুমি যেখানে বসে আছো।
বটগাছ কি কখনো কথা বলতে পারে?
হ্যাঁ পারে। এই যে আমি বলছি।
তা হলে তুমি কাঁদছো কেন?
সেই কথাই তো তোমাকে শোনাতে চাই। তুমি কি শুনবে?
ঠিক আছে শুনব বলো।
অনেক দিন আগের কথা। এই স্কুলটা তখন নতুন তৈরি করা হয়েছে। মাত্র কয়েক মাস ক্লাস শুরু হয়েছে। তোমার দাদা এবং কয়েকজন সহযোগী মিলে একটি পুরোনো বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে তুলে এনে আমাকে এখানে জায়গা করে দিয়েছে। সেই থেকে আমি এখানে থাকছি, বড় হচ্ছি। কিন্তু জানো আজকে কী হয়েছে?
কী?
কিছু লোক আমার হাতগুলো কেটে ফেলেছে। দেখো সেখান থেকে রক্ত ঝরছে।
হ্যাঁ এগুলো তো রক্ত নয়, এগুলো তো কষ বের হচ্ছে।
হ্যাঁ বাবা তোমাদের কাছে এটাকে কষ মনে হচ্ছে। কিন্তু এটাই আমার রক্ত। তোমাদের যেমন জান আছে আমারও তো জান আছে, আমার প্রাণ আছে। তোমরা বড় হচ্ছো ছোট থেকে। আমিও ছোট থেকে কত বড় হচ্ছি দেখো। আগে আমি একদম তোমার মতো পাতলা ছিলাম। তারপর আস্তে আস্তে আমার ডালপালা হয়েছে, আমার দাড়ি হয়েছে। দাড়ি মানে আমার ডালপালা থেকে যে শেকড়গুলো দেখতে পাচ্ছো এগুলো আর কি। আস্তে আস্তে আমি বহুদূর পর্যন্ত আমার হাত-পা মেলে দিয়েছি। তুমি জানো হাজার হাজার লোক আমার ছায়াতলে এসে বসে আশ্রয় নেয়। শান্তির সুবাতাস পায়, শীতল হাওয়া খায়। অনেক পাখি আমার ডালে আমার পাতায় লুকিয়ে থাকে, আমার এখানে জীবন ধারণ করে, বাসা বানায়। অথচ মানুষ আমাকে মূল্যায়ন করে না। শুনেছি আমাকে নাকি কেটে ফেলা হবে। আমার পাতায় নাকি স্কুলের ছাদ আর উঠান নষ্ট হয়। আচ্ছা তুমি বলো তো তোমাদের জন্য কি অক্সিজেন দরকার নেই? তোমাদের জন্য কি ছায়া দরকার নেই? তোমাদের জন্য কি পরিবেশ রক্ষার দরকার নেই? পরিবেশের জন্য কি পাখিদের দরকার নেই? তা হলে কেন আমাকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে তোমাদের স্কুলের কমিটির লোক?
কিন্তু আমি তোমার জন্য কী করতে পারি? আমার তো কিছুই করার নেই। আমি তো ছোট। তা ছাড়া আমার কথা কেউ শুনবে না।
তুমি এক কাজ করতে পারো, তুমি হেডমাস্টারের সঙ্গে কথা বলবে। তাকে বুঝিয়ে বলবে বটগাছটা আমাদের অক্সিজেন দেয়, পথিকরা এর ছায়ায় বসে, পাখিরা এর ডালে বাসা বাঁধে। কত সুন্দর লাগে! তুমি তোমার হেডমাস্টারকে বোঝাও। হয়তো তোমার কথা শুনতেও পারে।
তুমি যখন এত করে বলছো ঠিক আছে তা হলে আমি সাহস করে আমার স্যারের সঙ্গে কথা বলে দেখব।
সত্যি টুটুল তুমি একটা লক্ষ্মী ছেলে। আচ্ছা তুমি কেন গাছের গোড়ায় বসে কাঁদছিলে আমাকে বললে না তো?
আমি তো কাঁদছিলাম এই জন্য যে, স্যার আমাকে আজ মেরেছে। মনটা খারাপ। তা ছাড়া আজ দাদু আমাকে নিতে আসেনি। তাই আমি রাগ করে বসে আছি।
তোমার দাদু বৃদ্ধ মানুষ। সে তো ভুলেও যেতে পারে। তা ছাড়া সে অসুস্থও হয়ে পড়তে পারে। এ জন্য তোমার রাগ করে বসে থাকা ঠিক হবে না। তুমি তো বাসা চেনো। তুমি একাকী যাও এক দিন। তোমার অনেক সাহস হবে, তোমার অভিজ্ঞতা হবে। তোমার কখনো মন খারাপ হলে তুমি আমার কাছে চলে এসো। আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু। তুমি আমার এখানে এসে বসবে, তোমার সঙ্গে আমি কথা বলব।
‘আচ্ছা’, জবাব দিল টুটুল। একটু পর ওপথ ধরে টুটুলের বন্ধু টগর যাচ্ছিল। টুটুলকে ওখানে বসে থাকতে দেখে বলল, টুটুল এখানে বসে আছিস কেন? বাসায় যাবি না?
হ্যাঁ যাবো।
তা হলে চল যাই।
ঠিক আছে চল।
ওদিকে তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
চাচ্চুর দোকানে গিয়েছিলাম।
এরপর ওরা কথা বলতে বলতে বাসার দিকে ফিরে গেল।
সময়ের আলো/আরএস/