মিসরীয় কবি গালাল আল বেহাইরি কারাগারে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন বলে জানিয়েছে পেন ইন্টারন্যাশনাল। তিনি গত পাঁচ বছর ধরে মিসরের কারাগারে বন্দি আছেন।
১৮ সেপ্টেম্বর সোমবার পেন ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘ইংলিশ পেনের একজন সম্মানিত সদস্য বেহাইরি, ৯ সেপ্টেম্বর আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। সময়মতো কারাগারের হাসপাতালে নেওয়ায় তার প্রাণ রক্ষা পায়।’ লেখকদের বৈশি^ক এই সংস্থাটি জানিয়েছে, সেপ্টেম্বরের শুরুতে দীর্ঘদিন ধরে তাকে নির্বিচারে জেলে আটকের প্রতিবাদে অনশন শুরু করেছিলেন।
বেহাইরি বর্তমানে মিসরের বদর কারাগারে আছেন। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসিকে উপহাস করে একটি গান লেখার কারণে তাকে কারারুদ্ধ করা হয়েছে। মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার এবং সামরিক প্রতিষ্ঠানকে অপমান করার জন্য তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। তাকে তিন বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি ৫৬০ ডলার জরিমানা করা হয়েছিল।
২০২১ সালে তার মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। সে সময় পাবলিক প্রসিকিউটর অফিস একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থাকার দাবি করে তার বিরুদ্ধে নতুন অভিযোগ আনে। ফলে তাকে প্রাক-বিচার আটকের নির্দেশ দেওয়া হয়। ইজিপশিয়ান কমিশন ফর রাইটস অ্যান্ড ফ্রিডম এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, চলতি বছরের মার্চ মাসে তিনি প্রথম অনশন শুরু করেছিলেন। জেলে তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার, তাকে কাগজ এবং কলম দিতে জেল কর্তৃপক্ষের অস্বীকার করার কারণে প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি এই অনশন করেছিলেন। ৩৩ বছর বয়সি এই কবি ৫ সেপ্টেম্বর নতুন করে অনশন শুরু করেন। এবার বিনা বিচারে তাকে দীর্ঘ সময় ধরে কারাগারে আটকে রাখার প্রতিবাদে অনশন করেন তিনি। এদিকে পেন ইন্টারন্যাশনাল গালাল আল বেহাইরিকে আটকের নিন্দা করেছে। তার এই আত্মহত্যার চেষ্টার জন্য মিসরীয় সরকারকে দায়ী করেছে সংস্থাটি। উল্লেখ্য, বেহাইরিকে ২০১৮ সালের ৩ মার্চ ‘বালাহা’ নামের একটি গান প্রকাশের পরে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এই গানের গীতিকার ছিলেন তিনি। এই গানে তিনি পরোক্ষভাবে মিসরীয় প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসিকে নিয়ে মজা করেছিলেন। সিসি ২০১৩ সালে মিসরের সেনাপ্রধান ছিলেন। সে সময় তিনি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি দেশটির ক্ষমতা দখল করেন।
মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসিকে ব্যঙ্গ করে লেখা এই গানটি নিয়ে মিউজিক ভিডিও বানানোর কারণে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল ২৪ বছর বয়সি চলচ্চিত্র নির্মাতা শেদি হাবাশকে। বিনা বিচারে দুই বছর কারাবাসের পর কায়রোর কুখ্যাত তোরা কারাগারে তার মৃত্যু হয়।
এ প্রসঙ্গে শেদি হাবাশের আইনজীবী জানান, প্রেসিডেন্ট ফাত্তাহ আল-সিসির রোষানলে পড়ে সুইডেনে নির্বাসিত মিসরীয় সংগীতশিল্পী রামি এসামের ‘বালাহা’ নামের একটি মিউজিক ভিডিও পরিচালনা করেন শেদি হাবাশ। ২০১৮ সালে ওই মিউজিক ভিডিও প্রকাশের কয়েক দিন পরেই তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং বিনা বিচারে কারাগারে আটকে রাখা হয়। একই সঙ্গে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে এই গানের গীতিকার কবি গালাল আল-বেহাইরিকে। তিনি এখনও কারাগারে আটক রয়েছেন।
গীতিকার কবি গালাল আল-বেহাইরির এই ‘বালাহা’ শব্দটি মিসরীয় জনপ্রিয় একটি ক্লাসিক সিনেমা থেকে নিয়েছেন। যার অর্থ মিথ্যাবাদী। এই গানের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টকে খেজুরের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে এবং এর প্রতিটি লাইনে ফুটে উঠেছে প্রেসিডেন্ট ফাত্তাহ আল-সিসির সামরিক অভ্যুত্থান, মিথ্যার আশ্রয় এবং স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ড। ‘দ্য অ্যারাবিক নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটস ইনফরমেশন’ (এএনএইচআরআই) এক টুইট বার্তায় জানিয়েছে, বিচারহীনতা আর চিকিৎসার অভাবে কারাগারে দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পরে শেদির মৃত্যু হয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ৩ জুলাই মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করে দেশটির ক্ষমতায় আসেন স্বৈরাচারী শাসক ফাত্তাহ আল-সিসি।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনআন্দোলনটি হয় ২০১১ সালে, আরব বসন্ত নামের এই আন্দোলন তিউনিসিয়া থেকে দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে মিসরে। আরব বসন্তের ফলে পতন ঘটে মিসরের দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসক জেনারেল হোসনি মোবারকের, শুরু হয় মিসরের গণতান্ত্রিক বিবর্তন। মিসরে রাষ্ট্রের উপস্থিতি হাজার বছরের, মিসরের রাজনৈতিক ইতিহাসও সুদীর্ঘ। মিসরের হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন মোহাম্মদ মুরসি, আরব বসন্তের পরে প্রথম নির্বাচনে তিনি ছিলেন মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থী।
গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি ক্ষমতায় ছিলেন এক বছর, মুরসির অধীনে বদলে যাচ্ছিল আঞ্চলিক রাজনীতিতে মিসরের অবস্থান। চলমান রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের মধ্যে এক বছরের মাথায় মিসরে ঘটে সামরিক অভ্যুত্থান, সেনাপ্রধান ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির নেতৃত্বে মিসরের ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী। ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা হয় মোহাম্মদ মুরসিকে, বিচারাধীন অবস্থায় মুরসি মারা যান ২০১৯ সালে। শুরুতে পরোক্ষভাবে ক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন জেনারেল সিসি, পরে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের মাধ্যমে অধিষ্ঠিত হন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে।
অন্যান্য স্বৈরশাসকের মতোই জেনারেল সিসিকেও কট্টর ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় যেতে হয়েছে। মিসরীয়দের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েই বন্ধুত্ব করেছেন ইসরাইলের মতো নিপীড়ক আর বর্ণবাদী রাষ্ট্রের। যেকোনো ধরনের সমাবেশকেই ‘অবৈধ জনসমাবেশ’ হিসেবে আখ্যায়িত করার সুযোগ রাখা হয় ২০১৩ সালের তৈরিকৃত আইনে। তবে সৌদি আরবের কাছে ২০১৬ সালে দুটি দ্বীপ হস্তান্তর করেন জেনারেল সিসি, এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে জেগে উঠেছিল মিসর। সেটি অবশ্য রাজনীতিতে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই থেকে গেছে। যেমন বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে থেকেছে ২০১৯ সালের আরেকটি আন্দোলন।
মিসর তুলনামূলকভাবে একটি দরিদ্র দেশ হলেও মধ্যপ্রাচ্য আর আফ্রিকার রাজনীতিতে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক মিসর। রাজনীতিতে মিসরের প্রাসঙ্গিকতা তৈরি করেছে ভৌগোলিক অবস্থান, রয়েছে মিসরের সামরিক বাহিনীর ভূমিকাও। জেনারেল সিসির অধীনে মিসরের সবচেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে সৌদি আরবের সঙ্গে, বিভিন্ন সময়ে সৌদি আরব অর্থনৈতিক সহায়তাও দিয়েছে মিসরকে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গেও সুসম্পর্ক রয়েছে জেনারেল সিসির মিসরের, বিভিন্ন সামরিক আর অর্থনৈতিক বিষয়ে যৌথ সম্পর্ক রয়েছে দুই দেশের। জেনারেল সিসি, মোহাম্মদ বিন সালমান আর মোহাম্মদ বিন জায়েদকে বিভিন্ন সময়ে একসঙ্গে সময় কাটাতে দেখা গেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশগুলোর বাইরে ইসরাইলের সঙ্গেও সুসম্পর্ক আছে জেনারেল সিসির, বিভিন্ন সময়ে তিনি চেষ্টা করেছেন ফিলিস্তিন আর ইসরাইলের মধ্যে শান্তিচুক্তি করার। ইসরাইল আর সৌদি আরবের সূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সুসম্পর্ক রয়েছে জেনারেল সিসির। মিসরের সামরিক বাহিনীরও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্কের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। হোসনি মোবারকের পতনের পর জেনারেল সিসিই প্রথম নেতা, যিনি যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় সফরের আমন্ত্রণ পান। ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই জেনারেল সিসি ক্রমাগত কর্তৃত্ববাদী হয়েছেন। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণকে কুক্ষিগত করেছেন। নির্বাচনি কাঠামোকে ধ্বংস করে দিয়েছেন, আইনসভার সদস্যরাও প্রায় সবাই তার আর্শিবাদপুষ্ট।
রাজনৈতিক বহুত্ববাদ নেই, নেই স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক দল গঠনের সুযোগ। কোনো গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য আন্দোলন করতে চাইলে সেটি রাষ্ট্র থেকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীদের ওপর নির্বিচার দমন-পীড়ন চলেছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে মুসলিম ব্রাদারহুডের কর্মী আর নেতাদের বিপক্ষে। ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও জেনারেল সিসির আর্শিবাদপুষ্ট হয়ে কিছু ইসলামিক রাজনৈতিক দল নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। নির্বাচনে বিরোধী দলের জেতার বাস্তবসম্মত সুযোগ কম। নাগরিকরাও স্বাধীনভাবে তাদের নির্বাচনি পছন্দ জানাতে পারেন না। বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্র্য নিয়ে যেসব কমিউনিটি রয়েছে, তাদের স্বাধীনতার মাত্রাও অত্যন্ত সীমিত। জেনারেল সিসির অধীনে সামরিক আর বেসামরিক আমলাতন্ত্র দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
গত দশকে মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশে করুণ পতন হয়েছে স্বৈরশাসকদের, অনেকেই নিহত হয়েছেন বিদ্রোহীদের হাতে। নিজের দুর্ভাগ্যের পাশাপাশি এসব স্বৈরশাসক জনগণের জন্যও দুর্ভোগ ডেকে নিয়ে আসেন, জনগণকে যেতে হয় দুর্ভিক্ষ, গৃহযুদ্ধ কিংবা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নির্যাতনের মুখে। স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে রাজনৈতিক উত্থান-পতনের এই চক্রাকার খেলা চলতেই থাকে। নাগরিকরা যতদিন এই চক্রটি ধরতে না পেরে অবকাঠামোগত উন্নয়নের বিনিময়ে কর্তৃত্ববাদী শাসকদের বৈধতা দেবে, ততদিন এই চক্র চলতেই থাকবে। লাতিন আমেরিকার দেশগুলো ২০০ বছরেও এই চক্র ভাঙতে পারেনি, পারেনি উন্নয়নশীল দেশ থেকে নিজেদের উন্নত দেশে পরিণত করতে। ফাত্তাহ আল-সিসিকে উপহাস করে লেখা গানটিতে কণ্ঠ দেওয়া সংগীতশিল্পী এসাম বর্তমানে সুইডেনে নির্বাসনে রয়েছেন। মিসরীয় মানবাধিকার আইনজীবী আবদেল রহমান আয়্যাশ জানিয়েছেন, ‘শাদি কারাগারে বেশ কয়েক দিন ধরেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, তার সহকর্মীরা সাহায্যের জন্য কেঁদেছিল কিন্তু স্বৈরাচার সিসির জেল কর্তৃপক্ষ ও কারারক্ষীরা তার শেষ নিশ্বাস ত্যাগের আগ পর্যন্ত কোনো প্রকার সাহায্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি।’ অর্থাৎ বিনা চিকিৎসায় তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার সব বন্দোবস্ত করে রেখেছিল জেল কর্তৃপক্ষ!
উল্লেখ্য, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অনুমান করেছে যে ২০১৪ সালে সিসি রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর থেকে ৬০ হাজারেরও বেশি রাজনৈতিক বন্দি মিসরের কারাগারে বন্দি ছিল।
প্রাক্তন সেনাবাহিনী জেনারেল বর্তমান ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট সিসি মিসরের রাজনৈতিক ইতিহাসের সর্বপ্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে হটিয়ে ক্ষমতা দখলের পর থেকে একই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ ও মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মীদের জেলে নিয়েছেন। চিকিৎসায় অবহেলা বা অন্যান্য কারণে আটক থাকা অবস্থায় কয়েকশ লোক জেল হেফাজতেই মারা গেছেন।
সহকারী সম্পাদক, সময়ের আলো
সময়ের আলো/আরএস/